চীনের নেতা শি জিংপিং বাইডেন প্রশাসনকে পাশ কাটিয়ে কিসিঞ্জারের সঙ্গে সখ্যের মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। ১০০ বছর বয়সি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেটকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। শিসহ চীনের নেতারা কিসিঞ্জারকে বলেছেন, ‘চীনের জনগণ সব সময় আপনাকে মনে রাখবে।’ তার জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তারও ভূয়সী প্রশংসা উঠে এসেছে। এই আলোচনায় চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও ছিলেন, যিনি তার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষকে বেশ কয়েক দফা যথেষ্ট গালমন্দও করেছেন।
কিসিঞ্জারকে এই উষ্ণ অভ্যর্থনা আরো একটি উদাহরণ যে বেইজিং কূটনৈতিক চ্যানেলের বাইরে কীভাবে ওয়াশিংটনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করছে। বেইজিং সেসব মানুষকে কাছে টানতে চাইছে যাদেরকে তারা মনে করে বাইডেন প্রশাসনের ওপর হতাশা আছে। কিসিঞ্জারকে শিসহ অন্য নেতারা পুরোনো বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন।
বেইজিং চাইছে দুই পরাশক্তির মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা তৈরি করতে। বিল গেটসের সফরের সময় তারা তাকে পুরোনো বন্ধু বলে অভিহিত করেছেন। এলন মাস্কের সফরের সময় তারা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
এই ধরনের প্রচেষ্টা অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। বেইজিং মনে করে, বাইডেন প্রশাসন সামরিক, প্রযুক্তিগত এবং ভূরাজনীতিতে বেইজিংকে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করছে। চীন এটাও লক্ষ করছে যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ব্যাপারে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটরা একই অবস্থান গ্রহণ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে এবং এই নির্বাচনের প্রার্থী কারা, তা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের এই অবস্থানকে গৃহীত কৌশল বলেই মনে হয়। তারা প্রভাবশালী ব্যক্তিবিশেষকে হাত করতে চাইছে, যারা ভবিষ্যতে ওয়াশিংটনের অবস্থানে পরিবর্তন আনতে পারেন। সিআইএর সাবেক চায়না বিষয়ক প্রধান ডেনিস ওয়াইল্ডারের মতে, ‘যারা চীনের সঙ্গে অর্থনীতি এবং সার্বিক সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী, তাদেরকে উত্সাহিত করতে চেষ্টা করছে।’
কয়েক মাস যাবৎ দুই দেশের মধ্যে শীতল অবস্থা চলার পর দুই দেশ সম্প্রতি আবার নতুন করে বাণিজ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কাজ করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই উদ্যোগ খুব একটা অগ্রসর হয়নি। জন কেরি চীনের সঙ্গে কথা জলবায়ু প্রশ্নে বিশেষ কোনো অগ্রগতি আনতে পারেননি। বেইজিং মনে করে, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
ন্যানজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রফেসর জু ফেঙ বলেছেন, ‘কিসিঞ্জারের সফরকে চীন একটি লক্ষ হিসেবে ধরেছে। বেইজিংয়ের উদ্বেগ হলো, কী করে আমেরিকার পলিসি এলিটদের হাতে আনা যায়, যাতে চীনের ওপর চাপ তৈরির কৌশলকে কমানো যাবে।’
বেইজিং কিসিঞ্জারের সফরে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কতটা সোনালি অধ্যায় ছিল, যখন কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিসিঞ্জারের সেই সফরের সাত বছর ওয়াশিংটন এবং কমিউনিস্ট চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। চীনের কর্মকর্তারা বলেছেন, সেই সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে তিক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কিসিঞ্জারের সেই অবস্থানের দিকে ফিরে দেখা উচিত।
সেই কথা আরো এক বার স্মরণ করিয়ে দিতে এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝাতে মি এবং কিসিঞ্জারের আলোচনার আয়োজন করা হয় দায়োতি গেস্ট হাউজের ৫ নম্বর ভিলায়, যেখানে অর্ধশত বছর আগে কিসিঞ্জার ও চৌএন লাই একত্রিত হয়েছিলেন। চৌএন লাই তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
শি সিসিটিভিকে বলেছেন, ‘চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সঙ্গে সর্বদাই কিসিঞ্জার নামটি জড়িয়ে থাকবে। দুজন ক্রিম কালারের সোফায় পাশাপাশি বসা অবস্থা শি বলেছেন, ‘আমি আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।’
সরকারি বক্তব্যে মি. শিকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘আমার বিশ্বাস, আপনি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সচেতন নাগরিকরা দুই দেশের সম্পর্ককে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবেন।
এর আগের দিন চীনের অন্যতম পররাষ্ট্র বিষয়ক উচ্চ কর্মকর্তা ওয়াং ফি কিসিঞ্জারকে বলেছেন, ‘অমেরিকার প্রয়োজন কিসিঞ্জারকে স্টাইলের কূটনীতি এবং নিক্সন স্টাইলের সাহসিকতা।’
চীন বিল গেটস, এলন মাস্ত, টিম কুক, জেমি ডিমনের মতো ব্যবসায়ীদের কাছে টানতে চেষ্টা করছে। এদের সফরের সময় কেউ কেউ চীনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। এই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সফরও চীনকে সুযোগ দিয়েছে একটি বার্তা দেওয়ার যে বিদেশি আস্থা প্রয়োজন ব্যবসায়।
গত মার্চ মাসে কুকরে সফরের সময় অ্যাপেলের একটি শোরুমে সেলফি তুলেছেন এবং সরকারের উন্নয়ন ফোরামে যোগ দিয়েছেন। এবং তিনি লক্ষ করেছেন, তিন বছরের করোনা ভাইরাস থেকে উঠে আসা পরিবেশ।
দুই মাস পর এলেন মাস্ক চীন সফরে গিয়েছেন। তিনি সাংহাইয়ের উচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন চীনের প্রচারমাধ্যম টেসলা ও টুইটারের স্বত্বাধিকারী এলন মাস্ককে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কে প্রবক্তা বলে উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, কিসিঞ্জারের সফর সম্পর্কে বাইডেন প্রশাসন অনেক আগে থেকেই ওয়াকিবহাল। কিন্তু তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিকের যে প্রবেশাধিকার আছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের নেই। এই বিষয়টি সমাধান করা দরকার। তিনি বলেছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে একজন প্রাইভেট সিটিজেন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন, অথচ যুক্তরাষ্ট্র সরকার পারে না। কিরবি আশা প্রকাশ করেছেন যে কিসিঞ্জার তার সফর সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং তিনি বলেছেন দুই দেশের মিলিটারি অফিশিয়ালদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে শুরু করা হবে।
এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, শি চেষ্টা করছেন দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যকে এগিয়ে নিতে এবং শির আগ্রহে বোঝা যায় যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের পরিচালন ইউন ইউন বলেছেন, চীন যে কোনো উপায়ে বিদেশি বিনিয়োগকারী ধরে রাখতে চাইছে। তারা হাই-টেক কোম্পানিগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনের কাছে এখন এই হাই-টেক কোম্পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীন বিশ্বাস করে যে রাজনীতির বাইরে এই বড় বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারেন। কিন্তু সেই সঙ্গে চীন এটাও বোঝাতে চায় যে, চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করলে আখেরে লাভই হবে।
লেখকদ্বয়: টাইমসের সাংবাদিক ও নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিনিধি
[নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনূদিত]