মাদকের টাকায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে স্থানীয় রাজনীতি ও নির্বাচন। ইউনিয়ন পরিষদের এক শ্রেণীর মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলার চেয়ারম্যানরা মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত। স্থানীয় প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীও মাদকের টাকার ভাগ পান নিয়মিত। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারাও মাদক ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। স্থানীয় পুলিশ জানে ও তাদের কাছে তালিকা রয়েছে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত। নিয়মিত ভাগ পাওয়ার কারণে তারাও চুপ। মাদকের টাকার ব্যাপক দাপট এখন স্থানীয় রাজনীতি ও নির্বাচনেও। অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যানরা কয়েক কোটি ও মেম্বার-কাউন্সিলর প্রার্থী কোটি টাকার অধিক খরচ করেন।
পুলিশ-র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সড়ক পথে মাদকের চালান বেশি আসছে না। তবে আকাশ ও নৌপথে আসছে দেদারসে। কিছু চালান ধরা পড়লেও বেশ কিছু থাকছে অধরা। গডফাদাররা থাকছে পর্দার অন্তরালে। কখনো কখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি চালান ধরা পড়ে কিন্তু ভেতর দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে ২০টার বেশি চালান। একটি বড় চালান পার করে দিলে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। এ কারণে স্কুল-কলেজসহ সব পেশার মানুষ এখন মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। একটি এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ইত্তেফাকের এ প্রতিবেদকের কাছে দুঃখ করে বলেন, বাবা-ছেলে দুই জনই এক সময় আমাদের বাড়িতে কাজ করত। এখন তারা এখন শত কোটি টাকার মালিক। এলাকায় মাস্তান ও গুন্ডাপান্ডা পালেন তারা। এলাকায় ছোট-বড় যত ধরনের অপরাধ হয়, সব কিছুতেই তারা জড়িত। রাতে মোটরসাইকেল করে মাদক পাচার করে। ওই সব মোটরসাইকেলের কোন নাম্বারপ্লেট নেই।
মহানগর, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড, এমনকি ইউনিট পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক সরাসরি মাদক কেনাবেচা করছেন। টেকনাফ থেকে মংলা-খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে মাদক। সেখান থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কাউন্সিলর থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানদের মাদক কেনাবেচাসহ সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা, এমনকি গ্রাম-পাড়া-মহল্লা পর্যায়েও মাদকের সরবরাহ, কেনাবেচা চলছেই। দেশে মাদকের ব্যবহার ও প্রবেশ বেড়েছে। ইয়াবা ও আইচ আসছে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, আইচ দিয়ে ইয়াবা তৈরি করা হয়। আইচ হল খাঁটি মাদক। তবে বর্তমানে আইচের ব্যবহার সর্বাধিক। যেহেতু দেশের সিংহভাগ মানুষ বেকার।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, গবেষণায় উঠে এসেছে, আগামী প্রজন্ম ধ্বংস করার জন্য মাদকই হবে মূল কারণ। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তির মনস্বত্ববোধ থাকে না। তারা ধীরে ধীরে শিক্ষা, সমাজ সহ সব কিছু থেকে ঝরে পড়ছে। অপরাধ বাড়বে ব্যাপক হারে। অধিকাংশ খুনি মাদকাসক্ত। মাদকাসক্ত ব্যক্তি কাকে হত্যা করছে, সেই জ্ঞান তার থাকে না। এ কারণে বাবা-মা, ভাই-বোনকেও হত্যা করতে তারা দ্বিধা করে না। তাই এখন থেকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া এটাকে রোধ করা সম্ভব হবে না।
দেশজুড়ে মাদকের সর্বনাশা গ্রাস। ওয়ার্ড থেকে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মী থাকার পরও এই ব্যবস্থা কিভাবে চলে? কারণ তাদের ছত্রছায়া না হলে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা হতে পারে না। তারাও ভাগ পায়। এটা নিয়ে কেউ খেয়াল করছে না। এদিকে আসন্ন স্থানীয় নির্বাচনে মাদকের টাকার বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা করছেন অনেকে। স্থানীয় পর্যায়ে এমন পরিবেশ যা প্রকৃত রাজনীতিবিদ, যারা সৎ মানুষ তাদের অধিকাংশই রাজনীতি থেকে সরে আসতে চাচ্ছেন। কারণ মাদকের টাকার দাপটে তারা স্থানীয় প্রশাসন কিনে ফেলেছে। নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের। এখন আর বেকার যুবকরা চাকরি চায় না, কারণ তারা মাদক ব্যবসা করে বড় লোক হচ্ছে দ্রুত সময়ে।
মাদকের এই ভয়াল আগ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করার উপায়ও বলে দিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলেন, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরেও এক সময় বাংলাদেশের মতো মাদকের পরিস্থিতি ছিল। তখন তারা কেপিটাল পানিশমেন্ট দিয়েছিল। কারো কাছে ১০০ পিস ইয়াবা পেলেই ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এভাবেই ওই দুটি দেশ মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশকেও একই পদ্ধতিতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নইলে সামনে ভয়াবহ বিপদ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ মাদক আসছে মিয়ানমার থেকে নাফ নদী দিয়ে। মাদক বন্ধে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের মধ্যে আলোচনা হয়। নিয়ন্ত্রণে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরও হয়। মিয়ানমার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করলেও বাস্তবে কোন কাজ করে না। ওই দেশটির সরকারের পাশাপাশি সরকারবিরোধী আয় মূলত মাদক। আর বাংলাদেশ হলো তাদের মাদকের বড় বাজার। তাই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ঘরে ঘরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এম. খুরশীদ হোসেন বলেন, দেশে যেসব অপরাধ হচ্ছে তার মূল কারণ মাদক। র্যাবের পক্ষ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও অভিযান অব্যাহত আছে। কোন ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যেভাবে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, আমাদের দেশেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে জঙ্গীর মতো মাদকের বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, জেলখানায় যেসব আসামি আছেন, তার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মাদকের মামলায় গ্রেফতার। অর্থাত্ পুলিশ মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অপারেশন ও অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মাদক আসছে। তাই সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক ঘর থেকে শুরু করতে হবে, নিজেদের সন্তানরা কি করছে তা খুঁজে বের করা।