মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করিবার ইতিহাস বদলায় নাই


প্রায় সোয়া শত বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার গীতাঞ্জলি কাব্যে বলিয়া গিয়াছেন: ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’ ইহার পর তিনি তাত্পর্যপূর্ণভাবে উচ্চারণ করিয়াছেন মানুষের অধিকারের বিষয়টি। তিনি বলিতেছেন—‘অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’ তিনি ইঙ্গিত করিতেছেন সেই শ্রেণিকে—যাহারা, তাহার ভাষায়—‘মানুষের অধিকারে/ বঞ্চিত করেছ যারে,…।’

মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করিবার ইতিহাস সোয়া শত বৎসরেও কি পরিবর্তিত হইয়াছে? এই অপূর্ব কবিতাটি পাঠ করিলে অনেকেরই মনে হইতে পারে—ইহার প্রতিটি শব্দ-বাক্যই যেন এখনো সমভাবে প্রাসঙ্গিক। যেন কবিগুরু এখনো জীবিত এবং এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অবস্থা দেখিয়া তিনি গতকল্যই এই কবিতাটি রচনা করিয়াছেন! এই যদি হয় বর্তমান সময়ের বাস্তবতা—তাহা হইলে বলিতে হয়, আমরা যেন এই কবিতাটি রচনাকালের আঁচল ধরিয়া এখনো ঝুলিয়া রহিয়াছি। ইতিমধ্যে সূর্য সোয়া শত বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়াছে, পৃথিবীতে ঘটিয়া গিয়াছে কত ধরনের ভৌগোলিক পরিবর্তন; কিন্তু মোটা দাগে আমাদের মানস তথা মননজগতের যেন কোনো পরিবর্তন ঘটে নাই। উন্নয়ন কিংবা উন্নতির যত শতসহস্র মনোমুগ্ধকর চিত্র আমাদের সম্মুখে হাজির করানো হয়—তাহা কি আমাদের মানসজগৎ কিংবা আত্মিক পরিবর্তনের কোনো চিত্র প্রকাশ করে? এক কথায় বলা যায়—তাহা করে না। কারণ, আত্মিক পরিবর্তন আমাদের ঘটে নাই সেই অর্থে। যেই কারণে ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ কবিতাখানি এখনো প্রাসঙ্গিক হইয়া রহিয়াছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জন্য ইহা এক ট্র্যাজেডি। আমরা একটু সহজভাবে আত্মিক উন্নতি বুঝিতে চেষ্টা করি। বুখারি শরিফে (প্রথম খণ্ড) আত্মিক উন্নতি সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.) বলিয়াছেন যে, ‘জানিয়া রাখিও, শরীরের মধ্যে এমন একটি অংশ রহিয়াছে, তাহা যখন ঠিক হইয়া যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হইয়া যায়। আর তাহা যখন খারাপ হইয়া যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হইয়া যায়। জানিয়া রাখিও—সেই অঙ্গটি হইল কল্ব।’ আরবি শব্দ ‘কল্ব’-এর আক্ষরিক অর্থ হইল—হৃদয় বা মন। ইহার দ্বারাই পরিচালিত হয় বিবেক। বিবেক রত্নটির উন্নতি সাধিত হইলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হইবে এবং ইহার অবনতিতে সমগ্র মানবদেহেরই অবনতি ঘটিবে। বিবেকের কর্তব্য হইল সদাচার, সততা, সত্যতা দ্বারা পরিচালিত হওয়া। বিবেকের উন্নয়ন হইল উন্নত চিন্তা—যেইখানে সীমাবদ্ধতার সকল দাগ মুছিয়া চলিবে জীবন। সংকীর্ণতার সকল সীমা অতিক্রম করিয়া সামনে আগুয়ান হইতে হইবে। থাকিবে বুদ্ধির মুক্তি। সংকীর্ণতার মধ্যে কখনো উন্নত জীবনের জ্ঞানবৃক্ষ জন্মায় না। আত্মিক এই সকল উন্নতির সহিত সরাসরি সম্পর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে রহিয়াছে একটি ভূখণ্ডের সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, শিষ্টের পালন, দুষ্টের দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির এই সকল বিষয়ে কী অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করিতেছে—তাহা নূতন করিয়া বলিবার অপেক্ষা রাখে না। আমরা পুনরায় রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশ স্মরণ করিতে পারি। তিনি মাঝামাঝি অংশে বলিয়াছেন—‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।/ অজ্ঞানের অন্ধকারে/ আড়ালে ঢাকিছ যারে/ তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’

সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার সোয়া শত বৎসর পূর্বের কবিতার মর্মবার্তা দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে বুঝাইয়া দিয়াছেন—আমরা এখনো সেইখানেই স্থির ও স্থাণু হইয়া রহিয়াছি। নিশ্চয়ই এমনটি রহিবে না চিরকাল। সোয়া শত বৎসর পার হইয়া, হয়তো আরো কয়েক শত বৎসর পার হইবে সত্যিকারের ইতিবাচক পরিবর্তনের; কিন্তু একদিন পরিবর্তন হইবেই।
 





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/641305/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%B7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%87

Sponsors

spot_img

Latest

How Learning to Mountain Bike Helped Me in Early Motherhood

My daughter was five months old the first time I went mountain biking. As a new parent, when so much scared me, I...

How Unilever Is Preparing for the Future of Work

BRIAN KENNY: On...

Things I Loved in November 2022

Looking for more things I loved? You can browse every single one of my previous recommendations on the Things I Tried and Loved...

Dates, UK kick-off times and potential route to the final with Three Lions eyeing glory in Qatar

England’s path to World Cup glory has already been mapped out – but the Three Lions must first navigate a tricky group in...

I would love to be paired with Mickelson

Fred Couples' fans will be looking forward to Couples making his 38th Masters appearance. The Champions Dinner is a special topic since...