‘সবাই যদি জনপ্রিয় লেখকের পেছনে ছুটে তাহলে আমরা আলাদা কী করলাম’


ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ শুরু থেকে চেষ্টা করেছে ভিন্ন কিছু করতে। জনপ্রিয় ধারার দিকে না গিয়ে মূলধারায় কাজ করতে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫’শ বই তারা প্রকাশ করেছে। এবারের মেলায়ও তাদের ৫৪টি বই প্রকাশ হয়েছে। বই প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের রয়েছে লেখকের সঙ্গে নানা অভিজ্ঞতা। সেসবই জানতে চেয়েছিলাম প্রকাশক আদিত্য অন্তরের কাছে।
 
যতোটুকু জানি, আপনারা জনপ্রিয় ধারার চেয়ে একটু বাইরে, কেন এমন ভাবনা?

‘আমরা যখন পড়ালেখা শেষ করে বের হলাম তখন আমাদের ইচ্ছে ছিলো প্রকাশনা জগতে আসবো এবং ভালো কিছু করবো। সবাই যদি জনপ্রিয় লেখকের পেছনে ছুটে তাহলে আমরা আলাদা কী করলাম। দেশ ও জাতি তাহলে আমাদের কাছ থেকে কী পেলো? জনপ্রিয় ধারার বই হবে, ব্যবসা হবে। লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা শুধু ব্যবসাটা চিন্তা করি নাই। আমরা চেয়েছিলাম দীর্ঘ সময় ধরে এ ব্যবসায় টিকে থাকবো। আজকে ব্যবসা করলাম পরে চলে গেলাম এমন যেন না হয়। যেমন বাংলা সাহিত্য যতোদিন টিকে থাকবে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন এদের লেখা ততোদিন টিকে থাকবে।’

‘শুরু থেকে আমরা মূল ধারার প্রকাশক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সেদিক থেকে জনপ্রিয় ধারার বাইরে হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, হায়াৎ মাহমুদ, পূরবী বসু, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত তাদের বই বের করি। ২০০৩-০৪ সালের দিকে আমরা যখন নতুন প্রকাশনায় এলাম তখন যেটা হয় নতুন প্রকাশকদের কেউ পাণ্ডুলিপি দিতে চান না। আমরা তখন হতাশ হয়ে পড়লাম। আমরা নতুন বলেই হয়তো আমাদের ওপর কেউ ভরসা করতে পারছেন না। কিন্তু আমরা চাইছিলাম ভালো কিছু করতে। তারপরও আমাদের মতো চেষ্টা করতে থাকলাম। বিভিন্ন লেখকের কাছে যাওয়ার পর দুর্নাম করতেও শুনলাম নানা প্রকাশকের নামে। আমরা লেখকদের ভরসা দিতে চাইলাম যে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি।’

তাহলে শুরুতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে আপনাদের? 

‘যেমন হাসান আজিজুল হকের কথাই যদি বলি। আজকে উনার নতুন পুরাতন সব বইয়ের প্রকাশক কিন্তু আমরা। স্যারের মৃত্যুর পর উনার ছেলে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেন। তবে স্যারের সঙ্গে আমাদের প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল বেশ মজার। আমরা প্রথম প্রথম অনেকবার উনার কাছে গেলাম। কিন্তু উনি বাচ্চা মানুষ বলে আমাদের বই দিলেন না। অনেকবার যাওয়ার পর আমরা চিন্তা করলাম নতুন পলিসিতে এগোয়। তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আমরা আস্তে আস্তে দু’বন্ধু (জহিরুল আবেদীন জুয়েল) মিলে উনার প্রবন্ধগুলো সংগ্রহ করতে লাগলাম। এরপর এক সময় রাজশাহীতে হাসান স্যারের বাসায় গেলাম । যাওয়ার পর বললাম স্যার আমাদের এবার বই লাগবে? এক বছরতো হয়ে গেল। স্যার বললেন, ‘আমারতো কোনো পাণ্ডুলিপি নেই।’ আমরা বললাম, স্যার পাণ্ডুলিপিতো আমাদের কাছে আছে। আপনি শুধু দেখে দিবেন। এরপর পাণ্ডুলিপি বের করে দেওয়ার পর স্যার বেশ খুশি হলেন। বললেন তোমাদের ওপর ভরসা করা যায়। তাৎক্ষণিক তিনি বইয়ের নামটাও বলে দিলেন। বইয়ের নাম,‘ছড়ানো ছিটানো’। ওই নামেই কভার করা হলো। স্যারকে দেখালাম। স্যার সেটিও বেশ পছন্দ করলেন। সেই বইয়ের প্রতিটি লেখাই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্যারতো এমনিতেই আজেবাজে কোনো লেখা লেখেন না।’ 

সেই প্রথম ভালো একটা বই করার আনন্দ আপনাদের মধ্যে। কেমন সাড়া পেলেন?

‘একটা প্রবন্ধের বই যে মানুষের মাঝে এতোটা সাড়া ফেলবে আমরা তখন ভাবিনি। একটা উপন্যাস তখন যেভাবে বিক্রি হতো সেভাবেই বিক্রি হলো। একটা প্রবন্ধের বই মেলায় পাঁচ থেকে সাতশ কপি বিক্রি হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।’ 

লেখকের সঙ্গে আর কোনো স্মৃতি? 

‘হাসান আজিজুল হক স্যারের মতো একই ঘটনা সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তিনিও প্রথমে নতুন বলে বই দিতে চাননি। তার মানে আমাদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে হাসান স্যারের বইটি আমাদের বেশ সহায়তা করেছে। আমরা যখন সেলিনা হোসেনকে দেখালাম তিনি আমাদের বই দিলেন। এ প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হকের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। স্যারের তখন ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি বের হয়। তখন বইমেলা হতো বাংলা একাডেমির ভেতরে। আমরা বইমেলায় স্যারের পেছন পেছন হাাঁটি। কতো স্বপ্ন ছিল বইটি বের করার। কিন্তু বইটি বের করলো ‘সন্ধানী’। আশার কথা অনেক বছর পর হলেও ‘আগুনপাখি’ এখন আমাদের। এখন সেলিনা হোসেনের রচনাবলির কাজ শুরু করেছি। প্রথম খণ্ড প্রকাশ হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি খণ্ড হবে। উনার উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ আমরা করেছি। ‘ভূমি ও কুসুম’, ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’, ‘সোনালী ডুমুর’ এর প্রকাশক আমরা। শুরুতে সেলিনা হোসেনের বই যখন আমরা পাচ্ছিলাম না তখন ভাবলাম উনার প্রথম গল্পের বই কোনটা? ‘উৎস থেকে নিরন্তর’, ‘জলোচ্ছ্বাস’। আমরা বললাম এ দুটো বইতো বাজারে নেই। তখন এ দুটো বই আমরা নতুন করে প্রকাশের অনুমতি চাইলাম। তিনি অনুমতি দিলেন। সেই থেকে সেলিনা হোসেনের বই প্রকাশ শুরু করলাম।’ 
‘একই ঘটনা সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রেও। উনার যে বইটি আমরা প্রথম করি সেটির নাম ‘ময়লা জামায় ফেরেশতারা’। এটির নাম শুনলেই মনে হয় ধর্মীয় কোনো বিষয়-আশয়। আমরা যখন বইটি বের করলাম উনি মেলায় আমাদের স্টলে এলেন। বইটির প্রচ্ছদও ছিল চমৎকার। নিয়াজ চৌধুরী তুলি প্রচ্ছদ করেছিলেন। সৈয়দ হক বললেন, শেষ পর্যন্ত তোমরা এই নামে বইটি বের করলে?’ বইটি মেলায় বেশ বিক্রি হলো। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো প্রচুর হুজুর সৈয়দ হকের বই কেনেন। এমনিতে কে কী বলেন জানি না। সৈয়দ হকের একটা বড় পাঠক হচ্ছে হুজুর পাঠক। যারা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। কওমি মাদ্রাসার ছেলেদের দেখছি প্রচুর সৈয়দ হকের বই কিনতে। কেনো কিনতেন জানি না। পড়ার জন্য নাকি কিছু পান কিনা খুঁজে বের করতে!

এরপর কোন পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রকাশনার ধারণাকে?

‘এরপর আমরা চিন্তা করলাম বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ যারা আছেন তাদের জীবনী বের করবো। প্রথম বের করলাম হাসান আজিজুল হকের ‘ফিরে যায় ফিরে আসি’, আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড। এটাও বেশ বিক্রি হয়েছে। পরবর্তীতে চারখণ্ড এক করে আমরা ‘স্মৃতি কহন’ নামে। ইত্যাদির তখন একটি পরিচিতি ছিল যে তারা গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের আত্মজীবনী প্রকাশ করে। আমরা রফিক আজাদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, নির্মল সেন, বেলাল চৌধুরীর আত্মজীবনী প্রকাশ করেছি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা লেখকদের এই বার্তা দিতে চেয়েছি আমরা মূলধারার লেখকদের নিয়ে কাজ করি এবং মননশীল লেখকদের নিয়ে কাজ করি। 

এখনতো প্রকাশনা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে? 

‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলে গেছে। একসময় প্রবন্ধের বই যেভাবে বিক্রি হয়েছে এখন তেমন হয় না। এখন মানুষ কেনেন ‘দরকারি বই’। আগে যেমন মানুষ গল্পের বই, উপন্যাস খোঁজ করতেন সেটা অনেক কমে গেছে। অনেক মানে অনেক। এখন যিনি যে পেশায় কাজ করছেন বা করতে চান তিনি সে পেশায় স্কিল বাড়ানোর ওপর বই খোঁজ করেন। পাঠক কমছে সেটা আমি বলবো না। কারণ মানুষতো বই থেকে বিমুখ হতে পারবে না। বই হচ্ছে বড় বন্ধু। মানুষ যতোই ই-বুক, অডিও বুক পড়ুক না কেনো হার্ড বইয়ের আবেদন কখনো শেষ হবে না।’ 

লেখকের সঙ্গে মনোমালিন্যের মতো কোনো ঘটনা কি ঘটেছে? 

‘লেখক আর প্রকাশকের মনোমালিন্য সবসময় থাকে। বিশেষ করে প্রকাশকদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ থাকে যে তারা লেখকদের সম্মানী দিতে চান না। কিন্তু আমি বলি যে লেখকের বই বিক্রি হয় তাকে প্রকাশক তার প্রাপ্যের চেয়ে সবসময় বেশি টাকা দেয়। কারণ পরের বইটি যেন তিনি পান। ব্যবসার স্বার্থে সেটা দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে আর একটি গল্প মনে পড়ছে। যেমন হরিপদ দত্ত। তিনি বেশ শক্তিশালী লেখক। কিন্তু যখন তাঁর বই প্রকাশ করতে গেলাম। তিনি বললেন, তুমি কেনো এসেছ, আমার বইতো বিক্রি হবে না। লস করতে আসছো কেন। শেষে আমি বললাম বিক্রি হোক না হোক আমি বুঝবো। উনি পরে বললেন, টাকা পয়সা লাগবে না। আমার জন্য পান নিয়ে এসো। উনি প্রচুর পান খেতেন।





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/631122/%E2%80%98%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A7%81%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A7%9F%E0%A6%A6-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%B9%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%87

Sponsors

spot_img

Latest

OpenAI executive appears to have Twitter account hacked to promote cryptocurrency scam

Join top executives in San Francisco on July 11-12, to hear how leaders are integrating and optimizing AI investments for success. Learn More The...

a Goal from Seattle Kraken vs. Montreal Canadiens

(Seattle Kraken) with a Goal from Seattle Kraken vs. Montreal Canadiens, 12/06/2022 Source link: https://sports.yahoo.com/goal-seattle-kraken-vs-montreal-054432768.html?src=rss

Slow Women’s World Cup ticket sales prompt concern in New Zealand

FIFA on Friday announced the release of about 250,000 more tickets for the Women's World Cup, amid concerns about sales for matches in...

Twitter will no longer enforce its COVID-19 misinformation policy

Twitter is no longer enforcing its COVID-19 misinformation policy, scrapping it less than a month after Space Karen Elon Musk acquired the company....

May Universities Revoke Degrees Based on Findings of Ex-Student’s “Academic Misconduct in Pursuit of That Degree”?

The case is today's Hartzell v. S.O. (majority opinion by Justice Lehrmann); the court concludes the power is implicit in the statutory scheme...