মানুষ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস এবং আচরণবাদীদের মতামতের সহযোগিতা নিতে হয়। প্রাচীন যুগের বন্যমানুষ তার রাজনৈতিক কাঠামো, ধর্ম, বিশ্বাস, আস্থা, প্রথা, ঐতিহ্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করে সভ্য মানুষের রূপান্তরিত হয়েছে। সভ্যতার উদ্ভব নিয়ে প্রফেসর টয়েনবি বলেছেন, ‘ভৌগোলিক পরিবেশে মানুষের নৃতাত্ত্বিক উন্নয়নের ফল হিসেবেই সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। বরং মানুষ প্রয়োজনের প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে।’
মানুষ স্বভাবতই সৃজনশীল। সে সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই তার সৃজনশীলতার ছাপ রেখে চলেছে। প্রাচীন গুহাবাসী মানুষ গুহার ভেতর ছবি এঁকে তাদের বিশ্বাস ও কল্পনাকে ফুটিয়ে তুলেছে। মৃতপাত্র অলংকরণ, ভাস্কর্য, চিত্র, শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্য, নাটকের উদ্ভব ঘটেছে মানুষের পৃথিবীতে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে। মানুষ হয়েছে শ্রদ্ধার পাত্র।
ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়েছিল প্যারিসে বাস্তিল দুর্গ পতনের মধ্য দিয়ে। এই বিপ্লবের স্লোগান ছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা। কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক জাঁতাকলে জীবন ও জগত্ যখন পৃষ্ট, তখন আমাদের মনে উদয় হচ্ছে, কোথায় সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা? শান্তির পিপাসায় মানুষ ছুটে চলেছে। কিন্তু শান্তির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে মতাদর্শের শেষ নেই। কিন্তু কোন পথে আসবে শান্তি, তার বিচার মানবমস্তিষ্ক দ্বারা মীমাংসিত হতে পারে না। কারণ মানবমস্তিষ্ক প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত। এই প্রবৃত্তি প্রকৃত জীবন বোধকে আড়াল করে ফেলে। ফলে মানুষের কাছে প্রকৃত সত্য ও মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আজ পারমাণবিক যুদ্ধের আতঙ্কে বিশ্ববাসী শঙ্কিত। মানুষের হাতে যে পরিমাণ অস্ত্র আছে তা দিয়ে কয়েক বার পৃথিবীকে ধ্বংস করা যায়। বিশ্ববাসী আজ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে দিশেহারা। এই যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি, পরিণাম ও ফলাফল নিয়ে বিশ্ববিবেককে ভাবিয়ে তুলেছে।
মানুষের জাগতিক-মহাজাগতিক যত জ্ঞান আছে, সমস্ত জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: (১) বস্তুবাদী, (২) আধ্যাত্মিক। যার ফলে দার্শনিক সমাজে ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মানুষকে আদর্শের আলোকে জ্ঞানকে বিচার করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানে আমরা অণু, পরমাণু, কোয়ার্ক এবং পরবর্তী সময়ে Light, energy and motion প্রভৃতি পেয়ে থাকি। সুতরাং সারা সময় বস্তু বস্তুতে থাকতে পারছে না। সে পরিণত হচ্ছে অবস্তুতে। আবার অদৃশ্যমান সত্তা থেকে বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত সত্য। সুতরাং জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব মীমাংসার পথে। মানুষ সামাজিক, সংস্কৃতিক জীবন পালন করে আসছে। ফলে সামাজিক জীব হিসেবে তাকে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এই রীতিনীতি, প্রথা বিশ্বাস সে এড়িয়ে চলতে পারে না। যার কারণে বৃহত্ পরিসরে সে রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের অংশ। আর শান্তির অন্বেষায় তাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উভয় চিন্তাচেতনাকে গুরুত্ব দিতে হয়।
মানুষ অসহায় হিসেবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। একটি ইতর প্রাণী জন্ম গ্রহণের পরপরই সে খাদ্য খুঁজে পায় এবং খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এক জন মানবশিশু অসহায় অবস্থায় থেকে কোথাও খাদ্য খুঁজে খায় না। তাকে খাদ্য দিতে হয়। সিংহ, বাঘ, চিতা, হায়না, সাপের কাছে মানুষ অসহায়। এমনকি একটি ক্ষুদ্র প্রাণী বল্লার কাছে সে অসহায়। এই অসহায় জীবনটা জ্ঞানের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এই মানুষের যেমন আছে মানবিক দিক, তেমন আছে হিংস্রতার দিক। মানবিক গুণের কারণে সে যেমন জনতার বন্ধুতে পরিণত হয়, তেমনি হিংস্রতার কারণে সভ্যতা কাঁপতে থাকে। যে শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের ভেতর হিংস্রতা ও সন্ত্রাসবাদের শিক্ষা দেয় তাকে আমরা প্রকৃত শিক্ষা বলতে পারি না। আমাদের ভেতর কিছু লোক সৃষ্টি হয়, তাদের আমরা মানুষ না বলে পশু বলি। পশুদেরও ধর্ম আছে। সে সমগোত্রীয় লাখ লাখ পশুকে হত্যা করতে পারে না। এমনকি লাখ লাখ পশুর খাবার বিনষ্ট করতে পারে না। কিন্তু মানুষ পারে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু শিক্ষা দিতে হবে, যাতে মানুষ পশু না হয়ে সত্যিকার মানুষ পরিণত হয়।
শিক্ষাব্যবস্থায় আছে শিল্পকলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, চিকিত্সা, কারিগরি, প্রকৌশলী, কৃষি প্রভৃতি। একজন ব্যক্তি শিক্ষিত হলেন কিন্তু বাস্তবজীবনে মুক্তি হলো না। তাহলে আমরা তাকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত বলতে পারি না। শিক্ষাটা হতে হবে সত্যের শিক্ষা। তবেই মানুষ সমস্ত প্রকার অশান্তি থেকে মুক্তি পাবে। কারণ সত্যই সুন্দর, সত্যই মুক্তি। জাগতিক রঙিন চশমায় সত্য-মিথ্যার প্রভেদ টানা কঠিন। কারণ প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত হলে সে প্রকৃত সত্যের পথ খুঁজতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে যারা অবদান রাখবেন, তারা হলেন মানবজাতির মহান শিক্ষক। একজন শিক্ষককে হতে হবে সত্যের জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। নইলে তিনি আলো জ্বালাবেন কীভাবে। এই সমস্ত শিক্ষকরাই হলেন মানবজাতির আলোকবর্তিকাস্বরূপ। যেসব শিক্ষক জ্ঞানসম্পন্ন মানবিক গুণসম্পন্ন ও যাদের দৃষ্টি প্রসারিত, তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাম্পাসে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে লাইব্রেরি নেই, লাইব্রেরি থাকলেও পর্যাপ্ত বই নেই, যা আছে পুরোনো ঘুণে ধরা, শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই। জ্ঞানচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। বরং যারা সৃজনশীল কাজে সাক্ষর রাখেন, তাদের অপদস্ত করা হয়, তাদের লাঞ্ছনা ও তিরস্কারের শিকার হতে হয়। দুঃখজনক ব্যাপার। শিক্ষকরা হবেন ছাত্রদের জ্ঞানচর্চার সহযোগী। অনেক প্রতিষ্ঠানে স্টাডি ট্যুর, পিকনিক, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় না স্কাউটিং, বিএ, সিসি ডিবেটিং নেই। সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতা হয় না। যেসব শিক্ষক জ্ঞানচর্চা করেন, যাদের সৃজনশীল কর্মে জাতি দিকনির্দেশনা পায়, তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের অবদান শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যেক সুন্দর করতে তারা পথ দেখান। যাদের আদর ভালোবাসার ও শাসনে ছাত্রছাত্রীরা দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকে। তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পিএইচডি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শুধু একাডেমিক ডিগ্রিকে এত গুরুত্ব না দিয়ে শিক্ষকদের ছাত্র তৈরি, প্রজ্ঞা, প্রকাশনা, চিন্তা, একাডেমিক-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে অংশ গ্রহণ, আচার-আচরণ এবং চারিত্রিক মাধুর্যকে গুরুত্ব দিলে আশা করি শিক্ষাকতার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং জ্ঞানচর্চায় সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটুক এবং মানুষ পাক শান্তির ঠিকানা, আজকের দিনে একান্তভাবে এ আশাই করা যাচ্ছে।
লেখক: কলেজশিক্ষক