সৎ কথাটার অর্থ হলো সততা। কথায় সততা, কাজে সততা, ব্যবহারে সততা। যে কোনো ক্ষেত্রে সৎ বা সততা শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাভাব চলে আসে। কোনো মানুষ সৎ হলে সমাজে সবাই তাকে ভালোবাসে। প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে আবড়ালে তার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলে। সৎ মানেই এক ধরনের পরিশুদ্ধ, বিশুদ্ধ ভাব। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে ব্যতিক্রম দেখা যায় শুধু একটি ক্ষেত্রে। আর তা হলো ‘সৎ মা’!
মায়ের পূর্বে সৎ শব্দ যুক্ত হয়ে অত্যন্ত ভালো মা হওয়ার কথা। কারণ মা মানেই হলো পৃথিবীর সব ভালোর সমন্বয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে সৎ শব্দটা যুক্ত হওয়ার সাথে সাথে সবাই তাকে নেতিবাচক চরিত্র মনে করে, যা কখনোই উচিত নয়। অনেকেকেই হয়তো বাধ্য হয়ে সৎ মা হতে হয়। কিন্তু সৎ মা মানেই যে তিনি অসৎ, তা কিন্তু নয়।
সৎ মা মানেই কি খারাপ মা? একজন মা যখন সন্তান রেখে বাধ্য হয়ে অন্য সংসারে যায়, তখন সেই সংসারে মা’দের মেনে নিতে কেন এত দ্বিধা? এখানে তারাও তো একজন মায়ের ভূমিকা পালন করছে। এ জায়গায় কেন তাদের প্রতি সহানুভূতি থাকে না? কেন সৎ মা মানেই খারাপ মা? কেন মনে করা হয় সৎ মা আসলে আমার মা নয়? আমাদের সব লুটেপুটে নিয়ে যাবে। এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে সমাজে আমরা চলি। অথচ আমরাই আবার সমতার কথা বলি। সব মানুষ সমান, সেই ধারণা প্রচার করি। একজন মেয়ে, অন্য মেয়েকে বা একজন নারী অন্য নারীকেও এ ধরনের সমালোচনা করি। তাদের প্রতি সহানুভূতি নিয়ে কোনো আলোচনাই করি না। যা আদতে আমাদের কথা ও কাজের বড় অমিলকেই তুলে ধরে। এ ধরনের দ্বিচারিতা পরিহার করা উচিত।
অনেক সময় দেখি যে, নারীরাও তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পক্ষের সন্তানদের সৎ সন্তান বা সৎ ছেলে-মেয়ে হিসেবে দেখছে। সন্তান বা পরিবারের অপরাপর সদস্যরা যেমন তাকে সৎ মা মনে করছে, মা-ও দ্বিতীয় পরিবারের সন্তানদেরকে সৎ সন্তান মনে করছে। ঠিক মা সূলভ যে আচরণ, যে ভালোবাসা তার কাছ থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরিবারের সন্তানদের পাওয়ার কথা, তা এই মা দিচ্ছেন না তাদেরকে। বহু শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেও এমন বিভেদ দেখা যায়। শিক্ষিত পরিবারের মধ্যেই যদি এমন বিভেদ থাকে, তাহলে অন্য সাধারণ পরিবারের মধ্যে এই বিভেদ কত গভীর তা সহজেই অনুমেয়। গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিব মানুষদের মধ্যে এই বৈষম্য আরও বেশি বিদ্যমান। দিন যত যাচ্ছে, এ বিভেদ-বৈষম্য বেড়েই চলেছে।
সমাজের বা সংসারের বোঝা ভেবে মা হয়তো তার সন্তান ফেলে অন্য সংসারে চলে আসতে বাধ্য হয় অনেক সময়। জীবন সব সময় নিজের ইচ্ছেয় চলে না। নিজের চাওয়া মতো হয় না সব কিছু। না চাইলেও বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে অনেক সময় এমন অনেক কাজ করতে হয়, যা সে হয়তো আদতেই করতে চায় না। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই একজন মা তার গর্ভের সন্তান, তার নাড়ী ছেঁড়া ধন ছেড়ে পাড়ি জমায় অন্যের সংসারে। অথচ নতুন ঘরের সন্তানদেরও মা হতে পারে না সে আর। ইচ্ছে থাকলেও পারে না। পরিচিত হয় সৎ মা হিসেবে। যেখানে তাকে পরিবারের অংশই মনে করা হয় না অনেক সময়।
অন্যদিকে নিজের পেটের সন্তানের মা-ও হতে পারে না সে। কারণ, সন্তানের অভিযোগ ‘আমাদের রেখে তুমি চলে গিয়েছিলে!’ এহেন অবস্থায়, সেই মায়েদের মানসিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান ঠিক কী হয়, তার প্রমাণ চোখের সামনে অহরহ দেখা যায়। এ ধরনের মায়েদের না থাকে এ কূল, না থাকে ও কূল। এসব মায়ের নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিত। পরিবারের সকল সদস্যদের এ নিয়ে কথা বলা উচিত। পুরুষ সদস্যদের ভূমিকাও এখানে কম নয়। তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে যেসব নারীকে ঘরে এনে তোলেন, তাদের সঙ্গে পরিবারের অপর সদস্যদের সম্পর্কটা যেন সুন্দর হয়, সেই চেষ্টা করা উচিত।
আর নারীরা, যারা সব বুদ্ধি-বিবেচনা থাকার পরও স্বেচ্ছায় টিপিক্যাল বিমাতা সূলভ আচরণ করেন দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানদের প্রতি, তাদেরকে এ আচরণ শুধরে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবন একটাই। এখানে সৎ নাম নিয়ে অসৎ কাজ-কর্ম করে তা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। একজন মা, সবসময়ই মা। সব সন্তানই মায়ের কাছে একজন সন্তান। মায়েরা কখনো সৎ হয় না। হওয়া উচিত নয়।
এমন একটা সমাজে আমরা বাস করি, যে সমাজ খুব বেশি জাজমেন্টাল। খুব সহজেই কাউকে ভালো বা খারাপ রায় দিয়ে দিতে আমাদের দেরি হয় না। এমন সমাজে এমন লেখা লিখতে ভয় হয়। কিন্তু আমরা যদি সবাই এগিয়ে আসি তাহলে এই ভয় ডিঙিয়ে সব সম্পর্কগুলোকে সুন্দর করা যায়। এমন একটা সমাজ গড়ে তোলা যায়, যেখানে সৎ মা বা অসৎ মা বলে কিছু থাকবে না। যেখানে থাকবে শুধুই একজন মা। জীবনের গোলকধাঁধায় স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মা থেকে সৎ মা বনে যাওয়া পৃথিবীর সকল সৎ মাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা।