আজকের ব্যস্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের যাতায়াতে বিরাট অন্তরায় ছিল কালিগঙ্গা নদী। তখন কালীগঙ্গার রূপ ছিল প্রমত্তা। মানিকগঞ্জের তরা এলাকায় ছিল ফেরিঘাট, চলাচল করতো বড় জাহাজ আর বাণিজ্যিক নৌ-বহর। ফেরি পারাপার হয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষজন ঢাকা যাতায়াত করতেন। ফেরিঘাটে যেমন যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল, তেমনি ছিল সিনেমার চিত্রায়ন লোকেশন। ছিল কত-শত মানুষ, কত ঘটনা-দুর্ঘটনা!
আজ তা কেবলই স্মৃতি। তেমনি এক স্মৃতির ধারক আব্দুল মুন্নাফ। তার স্মৃতি স্বাধীন বাংলার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যের। ফেরিঘাটে চা খেয়ে এক কিশোরের হাতে ৫০ টাকার নোট গুঁজে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনকার সে কিশোর এখন প্রায় ৭০ বছরের পৌঢ়।
আব্দুল মুন্নাফের বাড়ি ঘিওর উপজেলার জাবরা নয়াপাড়া গ্রামে। পিতা ফুলচাঁনের ছিল ৮ সন্তান। অভাবের সংসার। বাধ্য হয়ে আব্দুল মুন্নাফ তরা ফেরিঘাটে ছোট্ট এক ঝুপড়ি ঘরে চায়ের দোকান দেন।
সেই স্মৃতির কথা জানতে চাইলে চোখে মুখে এক উজ্জ্বল জ্যোতি ছড়িয়ে আব্দুল মুন্নাফ বলতে লাগলেন, ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় খালাস পেয়ে বঙ্গবন্ধু আরো সঙ্গী নিয়ে ঢাকা ফিরছেন। ঘাটে ভিড়, হঠাৎ তিনি গাড়ি থেকে নামলেন। সাধারণ মানুষ আর দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। এরপর সেই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। ১৩/১৪ বছরের কিশোর মুন্নাফ গামছা দিয়ে চেয়ার মুছে দিলেন। বঙ্গবন্ধু বসলেন। বললেন ভালো করে চা দাও।
এসব বলতে বলেতে অশ্রুসিক্ত প্রবীণ মুন্নাফ; তবু বলে যাচ্ছেন- চা বানাচ্ছেন তিনি আর বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে চা দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আরো কয়েকজন চা খেলেন। ‘তোমার চা ভালো হয়েছে। এই নাও বাবা এটা তোমার বকশিশ।’ এই বলে কিশোর মুন্নাফের হাতে ধরিয়ে দেন ৫০ টকার একটি নোট। মাথায় বুলিয়ে দেন পরশ। এরপর গাড়িতে চড়ে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর আসার খবরে ঘাট এলাকায় লোকের ভিড় ছিল। সবাই বলাবলি করছিল মুন্নাফ তোর ভাগ্য ভাল। এমন একজন মানুষের আশীর্বাদ তুই পেলি।
এরপর ১৯৭৩ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের কালিগঙ্গার বুকে নির্মিত হয় সেতু। উঠে যায় ফেরিঘাট, উঠে যায় মুন্নাফের মতো আরো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান। চা দোকানি কিশোর মুন্নাফের বয়স এখন ৬৭ বছর। চার সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে অনেকটা অভাব অনটনের দিন কাটছে তার। অনেক কিছু ভুলে গেলেও সেই স্মৃতি আগলে রেখেছেন অন্তরাত্মায় সযত্নে। তার চাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছে থেকে একবার দেখার।
গত শনিবার (২৫ মার্চ) জাবরা গ্রামের আব্দুল মুন্নাফের বাড়ি গেলে সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে।
আব্দুল মুন্নাফ বলেন, ‘জীবনে প্রথমবার তাকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে আমার হাতের চা খাওয়াতে পেরে আমার মাঝে যে খুশির জোয়ার বয়ে গেছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৫০ টাকার সেই নোটটি, যা হারিয়ে গেছে। ৩০ বছর যত্নে ছিল। হঠাৎ কালীগঙ্গা নদীতে বসত বাড়ি ভেঙে যায়, নতুন ঠিকানায় আবাস গড়ি। এরপর থেকে আর খুঁজে পাচ্ছি না সেই ৫০ টাকার নোটটি।
তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল আজিজ এই ফেরিঘাটে বঙ্গবন্ধুকে কয়েকবার নদী পার করে দিয়েছেন।
তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু এখানে ছোট্ট এক দোকানে চা খেয়ে কিশোর চা দোকানিকে ৫০ টাকা উপহার দিয়েছিলেন। তখন ৫০ টাকা ছিল একজন শিক্ষকের এক মাসের বেতন।
অনেক দিন পর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থানের খোঁজ করতে গিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর চা দোকানি মুন্নাফের কথা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও জাবরা গ্রামের বাসিন্দা ফরিদুল ইসলাম খুঁজে বের করেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-ধন্য আবদুল মুন্নাফকে। স্মৃতিবিজড়িত তরা কালীগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবী জানান আব্দুল মুন্নাফসহ এলাকাবাসী।