দ্বীনকে জিন্দা রাখতে প্রয়োজন দাওয়াতি মেহনত


আদম-হাওয়ার সন্তানদের আল্লাহ জীবন ও সম্পদ—এই দুই নেয়ামত দান করেছেন। কারো সম্পদ অনেক, এতটাই বেশি যে গুনে শেষ করা যায় না। আবার কারো সম্পদ কম। এর মধ্যে কেউ কেউ চরম অভাবি। এই কম-বেশির মধ্যে কী হেকমত আছে তা আল্লাহই ভালো জানেন। কারো হায়াত অনেক দীর্ঘ, আবার কারো হায়াত সামান্য। এখানে কম-বেশি করার ক্ষমতা কারো নেই। এই দুই পুঁজি দিয়ে তিনি আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়ে তার ব্যবহার আমাদের নবীগণের মাধ্যমে শিখিয়ে দিয়েছেন

দুনিয়ার সব সৃষ্টি, সব মাখলুক আল্লাহ তাআলার পরিবারের সদস্য। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানুষের যেমন টান থাকে, হৃদ্যতা থাকে, ভালোবাসা থাকে, তেমনি আল্লাহ তাআলারও আছে। সব মাখলুকের সঙ্গেই আল্লাহর গভীর সম্পর্ক আছে, যেহেতু তিনি সব সৃষ্টির স্রষ্টা। এসব মাখলুকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাখলুক মানুষকে তিনি বেঁচে থাকার জন্য শারীরিক শক্তি ও সম্পদ দান করেছেন। শারীরিক শক্তি ও সম্পদ দানের পর তিনি মানুষকে সম্পূর্ণ আজাদ ও মুক্ত করে দেননি। এমন কোনো অনুমোদন দেননি যে, তোমরা শক্তি, সামর্থ্য ও সম্পদ পেয়ে যা খুশি তাই করবে। যেহেতু নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে থেকে মানুষকে চলতে ও ব্যয় করতে হয়, তাই তিনি যুগে যুগে হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে আমাদের নবী হজরত মোহাম্মদ (স.) পর্যন্ত অসংখ্য নবী ও রসুল পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে জীবনবিধানস্বরূপ তিনি চারখানা আসমানি কিতাবসহ আরও অনেকগুলো ছোট ছোট কিতাব নাজিল করেছেন, যেগুলোর মধ্যে মানুষের জীবন পরিচালনাসহ সম্পদ ব্যয়ের সঠিক দিকনির্দেশনা তিনি দিয়ে রেখেছেন, যাতে দুনিয়াবি জীবনযাপন ও সম্পদ ব্যয় মানুষের জন্য পরকালীন আজাব, বিপদ ও ধ্বংসের কারণ না হয়। নবী ও রসুল এবং পাশাপাশি কিতাব পাঠিয়েছেন মানুষকে আখেরাতের শাস্তি ও বিপদ থেকে রক্ষার জন্যই।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনুল মাজিদের শুরুতেই সুরা আল বাকারায় বলেছেন, ‘আলিফ-লাম-মিম, জালিকাল কিতাবু লা রইবা ফিহি, হুদাল লিল মুত্তাকিন।’ এ কথা বলে তিনি মানুষকে সতর্ক করেছেন। শক্তভাবে হেদায়াত তথা ইমান, নেক আমল ও আখেরাত—এই তিন জিনিসের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। দুনিয়াবী জীবন যখন ইমান ও আমলে সলিহা দ্বারা সুন্দর হয়ে যাবে, তখন মানুষের আখেরাতের জীবনও সুন্দর, সুখময় ও নিরাপদ হয়ে যাবে। আলিফ-লাম-মিম তিনটি অক্ষর, যার অর্থ একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। দুনিয়ার কেউই তার সঠিক অর্থ জানে না। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা বোঝাতে চাইছেন যে, এই শব্দ যেমন তোমাদের বোঝার সাধ্য নেই, বরং এর সব ক্ষমতা ও বুঝ আল্লাহর আছে। তেমনি সব ক্ষমতার মালিক হলেন আল্লাহ। তাই তোমরা বিনা বাক্যে নির্দ্বিধায় পড়ে নাও—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মোহাম্মদ (স.) আল্লাহর রসুল। আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা এবং রসুল (স.)-এর তরিকামতো জীবন যাপনের মধ্যেই ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তি নিহিত। রসুল (স.) সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’, অর্থাৎ আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে পথে আছে, সে পথেই আছে তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সুখ-শান্তি। তোমরা যদি সুখ, শান্তি, নাজাত ও রেহাই পেতে চাও, তবে আমার ও আমার সাহাবাগণের অনুসৃত পথ আঁকড়ে ধরো। রসুল (স.) ও সাহাবাগণের জীবনাদর্শই কেবল মানুষকে ভ্রান্তি ও গোমরাহির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এই দুই জীবনের মধ্যেই শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য ও সম্পদ ব্যয়ের অনুপম আদর্শ বিরাজমান। তাই আমাদের আদর্শ হলেন রসুল (স.)। আমাদের অনুকরণীয় ও আদর্শ হলেন খোলাফায়ে রাশেদাসহ সব সাহাবায়ে কেরাম। এর বাইরে আমাদের কোনো আদর্শ নেই।

দুনিয়ার সব মানুষ আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। আদম-হাওয়ার সন্তানদের আল্লাহ জীবন ও সম্পদ দুই নেয়ামত দান করেছেন। কারো সম্পদ অনেক, কারোটা এতই বেশি যে গুনে শেষ করা যায় না। আবার কারো সম্পদ কম। এর মধ্যে কেউ কেউ চরম অভাবি। এই কম-বেশির মধ্যে কী হেকমত আছে তা আল্লাহই ভালো জানেন। কারো হায়াত অনক দীর্ঘ, আবার কারো হায়াত সামান্য। এখানে কম-বেশি করার ক্ষমতা কারো নেই। এই দুই পুঁজি দিয়ে তিনি আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়ে এবং তার ব্যবহার আমাদের নবীগণের মাধ্যমে শিখিয়ে দিয়েছেন। হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে সব মুসলমানের আকিদা হলো, তাকে আল্লাহ তাআলা জীবিতাবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। তার গায়ে কোনো তির বা অস্ত্রের স্পর্শ লাগেনি। তিনি আবার কেয়ামতের আগে দুনিয়ায় আসবেন। এটা আমাদের ইমান ও বিশ্বাস। তার বিদায়ের পর প্রায় ৫০০ বছর পর্যন্ত কোনো নবী-রসুল দুনিয়ায় আসেননি। নবি-রসুল ও আসমানি বাণী না থাকার কারণে মানুষ চরম পর্যায়ের জাহিলিয়াত ও মূর্খতার মধ্যে ডুবে যায়। তাদের মধ্যে এই বোধটুকুও ছিল না যে, এক টুকরো পাথর আমার সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম নয়। আমল, আখলাক, ইমান ও আকিদার চরম বিপর্যয় নেমে আসার ৪৫০ বছর পর রসুল (স.)কে আল্লাহ নবী ও রসুলরূপে দুনিয়ায় পাঠালেন। তিনি এসে মানুষকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘ইয়া আইয়ুহান্নাসু, কুলু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু তুফলিহুন।’ অর্থাৎ, হে লোক সকল! তোমরা বলো, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, তবেই তোমরা সফলকাম হবে। এটাই ছিল আমাদের নবীসহ সব নবীর দাওয়াত।

রসুল (স.) আরো বললেন, ‘ইন্নি রসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামিয়া’। এখন থেকে আমি তোমরাসহ কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের জন্য প্রেরিত রসুল। হে দুনিয়ার সব নর-নারী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শ্রমজীবী, বেকার, সুস্থ-অসুস্থ, সবল-দুর্বল, ধনী-গরিব, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, মালিক-শ্রমিক, সাধারণ, মন্ত্রী, এমপি সবাই শোনো, আমি তোমাদের সবার জন্য নবী ও রসুল হিসেবে আগমন করেছি। আমি তোমাদের কাছে কালেমা নিয়ে এসেছি। এসেছি তোমাদের জীবনবিধান নিয়ে। রসুল (স.) যখন কালেমা তথা মানবজীবন বিধানের বাণী আরবের লোকদের কাছে পৌঁছে দিলেন, তখন আরবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত, আস্থার প্রতীক মোহাম্মদ সা. তাদের কাছে হয়ে গেলেন পর। তার থেকে সবাই দূরে সরে গেল। কিন্তু তিনি থামেননি, দমেননি। তিনি দাওয়াত দিতে লাগলেন। গোশতের কাজ তিনি অব্যাহত রাখলেন। তিনি জান ও মাল নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে দ্বীনের দাওয়াত দিতে লাগলেন। আমাদেরও আল্লাহ প্রদত্ত জান ও মালসহ দিনের দাওয়াত নিয়ে ঘুরতে হবে অফিসে, আদালতে, হাটে, বাজারে, শহরে, গ্রামে, রাস্তাঘাটে, দেশে, বিদেশে। পৃথিবীর সব জায়গায়, সবখানে। রসুল (স.)-এর মতো যখন আমরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে শিরক, জাহালত ও বেদয়াত দূর করতে সক্ষম হব, তখন আমাদের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সর্বত্রই আল্লাহর রহমত, সুখ, শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা চলে আসবে। এটাই ছিল রসুল (স.)-এর দুনিয়ায় আগমনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এ কাজই তিনি আজীবন করে গেছেন এবং আমাদের করতে শিখিয়েছেন।

বিদায় হজের ভাষণে রসুল (স.) আমাদের দ্বীনের এই দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়ে গেছেন। যেহেতু রাসূল (স.)-এর পর আর কোনো নবী ও রসুল আসবে না। বরং নবী-রসুলগণের যে দায়িত্ব ছিল, সেই দায়িত্ব উম্মতে মোহাম্মাদির। তাই মানুষকে হেদায়াতের প্রতি আহ্বান করা আমার বা আমাদের কাজ। রসুল (স.) বলে গেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে আল্লাহর কোরআন ও আমার সুন্নত রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা এ দুটি আঁকড়ে ধরে রাখো, তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। যদি আমরা কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক নিজের জীবন পরিচালনা করি, যদি আমরা কোরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরি, যদি আমরা কোরআন ও সুন্নাহ অনুসারে দাওয়াতি মেহনতে লেগে থাকি, তাহলে সেই নবী যুগের মতো, খোলাফায়ে রাশেদার যুগের মতো এবং সাহাবায়ে কেরামের সোনালি যুগের মতোই আবার পৃথিবী সুখ, শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং আল্লাহর রহমতে ভরপুর হয়ে উঠবে। আমরা নবী-রসুল ও সাহাবাগণের মতো দাওয়াতি মেহমত করব তো? ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সব ভাইকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সঙ্গে জড়িত রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার তাওফিক দান করুন, আমিন। (গত ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রদত্ত বয়ানের সার-সংক্ষেপ)।

লেখক: তাবলীগ জামাতের আন্তর্জাতিক শুরা সদস্য ও শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি, ভারত

উর্দু থেকে অনুবাদ: মুফতি হারুনুর রশীদ খান





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/628864/%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BE-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B9%E0%A6%A8%E0%A6%A4

Sponsors

spot_img

Latest

The stars are starting to align for England

I’ve had some amazing on-field coaches in my time at Leicester and the club routinely used to try and employ an inside-centre...

Watch Live: Neuralink Brain Implant ‘Show and Tell’ Update

Neuralink, the neurotechnology startup co-founded by Elon Musk that aims to directly connect our brains to computers, has been silent since showing a "mind Pong"...

Qatar lose again — but has a host nation ever been knocked out in the World Cup group stage?

Qatar had to wait 4371 days to play their first World Cup match on home soil after being announced as the hosts of...

France sets October deadline for Embiid to decide his Olympic team

Joel Embiid has a choice: He can play in the Paris Olympics next summer for France, the United States, or Cameroon (which earned...