আকাশপথে অবৈধভাবে আসা সোনা পাচার হচ্ছে সড়কপথে। বাস বা ট্রেনে বাহকের মাধ্যমে সোনা চলে যাচ্ছে সীমান্ত এলাকায়। এরপর সীমান্তের চোরাচালানিদের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ওপারে। সোনা চালানের গন্তব্য কখনো কলকাতা, কখনো মুম্বাই আবার কখনো দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের ১০ জেলার শতাধিক চোরাচালান রুট যেন সোনার খনিতে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের এসব রুটের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে সোনা। তা-ও আবার কেজি হিসাবে উদ্ধার হচ্ছে। একেকটা চালানে দুই-তিন কেজি থেকে ১০-১২ কেজি পর্যন্ত সোনা উদ্ধার হচ্ছে।
গত দুই মাসে সীমান্তের রুটগুলো থেকে ৫৪ কেজি সোনা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পাশপাশি গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩ জন বাহককে। এর পাশাপাশি গত চার বছরে সোনা উদ্ধার হয়েছে ৪৫০ কেজি। এই সোনার বাজারমূল্য আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে বিজিবি উদ্ধার করেছে ৫৪ কেজি, ২০২০ সালে ৮৮ কেজি, ২০২১ সালে ৫০ কেজি ও ২০২২ সালে ১৯৫ কেজি সোনা। এসব ঘটনায় ১৯০ জন বাহককে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের সবাই সোনার বাহক। তারা জানেন না যে কে এই চালানের মালিক। এসব সোনার চালান আকাশপথে বিভিন্ন বিমানবন্দর হয়ে দেশে আসে। এরপর ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সীমান্তে নেওয়া হয়।
সীমান্তে সোনা চোরাচালান বন্ধের বিষয়ে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান বলেন, আজ যে প্রযুক্তি আধুনিক মনে হচ্ছে, ঠিক আগামীকাল সেটা পুরাতন হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে চোরাকারবারিরা তাদের কাজ করেন। তাদের গ্রেফতার করার পর তারা কৌশলও পালটে ফেলেন। এ কারণে বিজিবিকে প্রতিনিয়ত কৌশল পালটে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করতে হয়। সীমান্তে সোনা, মাদক, অবৈধ পণ্য পাচার প্রতিরোধে বিজিবি কাজ করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোনা পাচারের সবচেয়ে বড় রুট যশোর জেলায়। এই জেলার সীমান্তে অন্তত ১০টি নিরাপদ রুট রয়েছে। বেনাপোল থানার সাদীপুর, পুটখালী, শার্শার শিকারপুর, ভবেরবেড়, দৌলতপুর, শ্যামলাগাজী রুটগুলোতে সবচেয়ে বেশি সোনা পাচারের ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া যশোরের মনোহরপুর, ছুটিপুর, কাশিপুর, শালকোনা, পাকশিয়া এলাকা দিয়েও পাচার হচ্ছে সোনা।
সোনা পাচারে চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে তিনটি রুট। এগুলো হলো—কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনা ও জীবননগর। এছাড়া সাতক্ষীরা লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ছয়টি রুট রয়েছে। এগুলো হলো ভাদিয়ালী, কালীগঞ্জ, শেরপুর, ভোমরা, নোংলা ও কৈখালী; মেহেরপুরের গাংনী, কুতুবপুর, কাতুলি ও বুড়িপোতা; কুষ্টিয়ার ধর্মদহ, প্রাগপুর, বিলগাতুয়া, চর ভবানন্দদিয়া; রাজশাহীর সোনাইকান্দি, হরিপুর, কাশিয়াডাঙ্গা, গোদাগাড়ী, চরখিদিরপুর, চর মাঝারদিয়া, আলাইপুর, বাঘা, চারঘাট ও মোক্তারপুর; চাঁপাইনবাবগঞ্জের মনাকষা, ঘুঘুডাঙ্গা, রামকৃষ্ণপুর, শিবগঞ্জ, কিরণগঞ্জ, ভোলাহাট, রামদাসপুর, সাপাহার; দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হিলি, কামালপুর ও বিরল; ঠাকুরগাঁওয়ের আমজানখোর, হরিপুর, আটঘরিয়া; কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ফুলবাড়ী এবং লালমনিরহাটের বুড়িরহাট, শ্রীরামপুর ও দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচার হয়।
সীমান্ত এলাকা দিয়ে সোনা পাচারে কৃষক, দিনমজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল ও জেলেদের ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথমে ঢাকা থেকে সড়কপথে বা ট্রেনে একজন বাহক সোনার চালান সীমান্ত এলাকার নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেন। বাহকেরা টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে রেখে সোনা বহন করেন। দুই দেশের পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাংলাদেশ ও ভারতের মোবাইল সিম ব্যবহার করেন। কথাবার্তা চলে এসএমএসের মাধ্যমে।
উল্লেখ্য, চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে দুবাই থেকে সবচেয়ে বেশি সোনা আকাশপথে পাচার করে থাকে। এছাড়া সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত থেকেও সোনা পাচারের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ধরা পড়ে। এ কাজে আন্তর্জাতিক সোনা পাচার সিন্ডিকেট নিজস্ব বাহক যেমন ব্যবহার করছে, তেমনি টাকার টোপে কখনো পাইলট, কখনো ক্রু, কখনো বিমানবালাকেও কাজে লাগায় তারা। তাছাড়া বিমানের ক্লিনার, ট্রলিম্যান এমনকি প্রকৌশলীরাও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা ধরা পড়ে। যাত্রীবেশী বাহকের সঙ্গে থাকা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ইলেকট্রিক মোটর, মানবদেহের বিভিন্ন অংশ, ট্রলির ওপরের হ্যান্ডেল ও মানিব্যাগে করে সোনা পাচারের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া রোগী সেজে হুইল চেয়ারে, ঊরুতে অ্যাংকলেট বেঁধে, জুতার মধ্যে, বেল্ট দিয়ে কোমরবন্ধনীর ভেতরে, শার্টের কলারের ভেতরে, স্যান্ডেলের সঙ্গে, সাবান কেসে, সাউন্ড বক্সের অ্যাডাপটরে, বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বা ওষুধের কৌটা, প্যান্টের নিচে শর্টসের ভেতরে, ল্যাপটপের ব্যাটারির ভেতরে, মানিব্যাগে ও গলায় চেইনের সঙ্গে ঝুলিয়ে লকেট হিসেবেও আনা হচ্ছে সোনার বার। এরপর নানা কৌশলে হাত বদল হয়।