নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সিডিএ ও সিটি করপোরেশন একে অপরকে দোষারোপ করছে। ইতিমধ্যে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেলেও জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলছে না। গতকাল রবিবারও নগরীর নিচু এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবদ্ধ এলাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে পিডিবি। নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, চলমান প্রকল্পে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এতে জনগণের টাকা খরচ হচ্ছে। আগে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
গত কয়েক দিনে জলাবদ্ধতা ভয়াল রূপ দেখছে নগরবাসী। বিশেষ করে চান্দগাঁও, বাকলিয়া, মোহরা, খাজা রোড, শুলকবহর, চকবাজার, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চৌমুহনী, বাদুড়তলা, কাপাসগোলা, কোরবানিগঞ্জ, মিয়াখান নগরসহ নিচু এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। নিচতলার বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়ে মালামালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে পিডিবি। সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসার আশপাশের এলাকায় গত তিন দিন যাবত স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টি কমলেও পানি স্থির হয়ে আছে। আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় কার্যালয়ের ভেতরে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি হয়েছে। এতে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
জলাবদ্ধতা নিয়ে সিডিএ সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করছে। সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস ইত্তেফাককে বলেন, ‘নালাখাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। সিটি করপোরেশন পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। প্রস্তাবিত বারাইপাড়া খাল খনন না হলে এই এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না।’
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, সিডিএর প্রকল্পের জন্য খালের বিভিন্ন স্থানে দেওয়া বাঁধগুলো ভেঙে ফেলা হলেও মাটি সরানো হয়নি। খালের মধ্যে মাটি রয়ে গেছে। মাটি তুলে রাখতে হলে খালের পাশে জায়গার দরকার। কিন্তু সিডিএ খালের পাশের জায়গা অধিগ্রহণ করতে না পারায় খালের মাটি তুলে রাখতে পারছে না। এতে খাল দিয়ে পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘বারাইপাড়া খাল খননের ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচটির মতো মামলা ছিল। তার মধ্যে আর দুটি মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আশা করি, আগামী বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’
নগরীর জলাবদ্ধতা অনেক পুরোনো। ইতিপূর্বে জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে বড় ধরনের কোনো প্রকল্পের কাজ হয়নি। আশির দশকে বাকলিয়া এলাকায় একটি খাল কাটা হয়েছে। কিন্তু তাতে সুফল পাচ্ছে না বাকলিয়াবাসী। এর বাইরে জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে চাক্তাই খালের তলা পাকা ও খাল পরিষ্কারের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে সরকারি সংস্থাগুলো। বর্তমানে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ চলছে।
বর্তমানে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে না বলে দাবি করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, কারণ চিহ্নিত করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এখন চলমান প্রকল্পগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ছাড়াই বাস্তবায়ন করছে। একটি মাত্র চাক্তাই খাল দিয়ে নগরীর পানি নিষ্কাশন সম্ভব নয়। এখানে নতুন করে খাল কাটতে হবে। বিরাজমান খালের প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। ভারী বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ের বালু খালে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুবাস বড়ুয়া ইত্তেফাককে বলেন, ‘আগে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এতে চলমান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। জনগণের টাকা খরচ করা হচ্ছে। নতুন করে খাল খনন করতে হবে। একটিমাত্র চাক্তাই খাল দিয়ে নগরীর পানি নিষ্কাশন সম্ভব নয়। ১৯৯৫ সালে প্রণীত মাস্টার প্ল্যান সিডিএ উলটিয়ে দেখেনি। গত ২৮ বছরে নগরীতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে কোনো মাস্টার প্ল্যান করা হয়নি। খালের মুখে যে স্লুইসগেট করা হচ্ছে তার প্রবেশমুখ খালমুখ থেকে ছোট। ফলে খাল দিয়ে দ্রুত পানি বের হতে পারবে না। আগেও কয়েকটি জায়গায় স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। দেখা গেছে, তিন-চার বছর পর অপারেশন নেই।’
সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, সিডিএ খাল থেকে কোনো মাটি উত্তোলন করেনি। চাক্তাই খাল, বির্জা খাল থেকে মাটি উত্তোলন করা হয়নি। বাকলিয়া ও চান্দগাঁও এলাকার খালগুলোতে মাটি পড়ে থাকায় পানি চলাচল করতে পারছে না। আমি সিডিএকে বলেছি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো কাউন্সিলরকে ডাকেনি, যার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।