রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিত্সকদের অবহেলার পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে নবজাতক মারা যাওয়ার সাত দিনের মাথায় মারা গেলেন মা। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় গতকাল রবিবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে মা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু হয়। ল্যাবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তার মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছেন স্বজনেরা।
ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন আঁখি। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে ছুটে আসেন সহপাঠীরা। শোকে পাথর হয়ে গেছেন সহপাঠী, বন্ধুরাও। মৃত্যুর খবর শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন আঁখির বোন খালেদা আকতার জুঁই। হাসপাতালের মেঝেতে বসেই করছিলেন আহাজারি। তিনি বলন, ‘মেরে ফেলছে, আমার বোনকে মেরে ফেলছে।’ মেঝেতে বসে আঁখির ভাই শামীম বলছিলেন, ‘বাবাও ঢাকায় এসে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন। আঁখিও তাই।’ আঁখির মৃত্যুতে সারা দেশে চিকিত্সকদের মধ্যেও ক্ষোভ ও হতাশা দেখা যাচ্ছে। ব্যাবসায়িক মানসিকতা ও অতি মুনাফা লাভের প্রবণতা পরিত্যাগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে চিকিত্সকসমাজ।
ঢাকার বাইরে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যে যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা থাকার কথা, তার কিছুই নেই। চিকিত্সায় অবহেলায় প্রতিদিন আঁখিদের মতো অনেকে মারা যান, তাদের খবর কেউ রাখে না। যে কোনো অপারেশন করতে হলে সেখানে আইসিইউ ও সিসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হয়। কিন্তু সেন্ট্রাল হাসপাতালে সিসিইউ ব্যবস্থাপনা ত্রুটিপূর্ণ ছিল, যে কারণে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও গাইনি চিকিত্সকদের সংগঠনের সিজারিয়ান করার ক্ষেত্রে যে গাইডলাইন আছে, তা মোটেও মানা হয়নি। ডা. সংযুক্তার বিরুদ্ধেও রোগী ভাগিয়ে নেওয়াসহ নানা অভিযোগ এসেছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রোগীদের আকৃষ্ট করতেন—এমন কথাও কোনো কোনো চিকিত্সক উল্লেখ করেছেন। তিনি কীভাবে অধ্যাপক হলেন—এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
ডা. সংযুক্তা জীবনে কখনো সরকারি চাকরি করেননি। একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। বেসরকারি হাসপাতালের অধ্যাপক হওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু গাইডলাইন মেনে চলতে হয়। ডা. সংযুক্তার ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখবে বিএমডিসি। এ তথ্য জানান বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান। তবে কোনো চিকিত্সকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিএমডিসি সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে পারে। এছাড়া আর কিছুই করতে পারে না বিএমডিসি। আঁখি ও তার নবজাতকের সঙ্গে খোদ রাজধানীতে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে ঢাকার বাইরের কী অবস্থা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতিদিন সিজারিয়ানের নামে দেশের কোথাও না কোথাও শিশু ও মা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কিন্তু এত হইচই হয় না, যেমনটি সেন্ট্রাল হাসপাতালের ক্ষেত্রে হয়েছে। চিকিত্সক ও রোগীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছার কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার মাহবুবা রহমান আঁখি। সেজন্য গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার চিকিত্সা নিয়েছেন। প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে কুমিল্লা থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে আসে তার পরিবার। আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, প্রসূতিকে ভর্তির সময় ডা. সংযুক্তা হাসপাতালেই আছেন বলা হলেও আসলে তিনি ছিলেন না। সেই রাতে ঐ চিকিত্সকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ঐ দিনই মারা যায়। সংকটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিত্সাধীন অবস্থায় গতকাল তার মৃত্যু হয়। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় চিকিত্সা নিতে এসে নবজাতক হারানোর পর মা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুকে ‘দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মৃত্যু অপ্রত্যাশিত। আমাদের আশা থাকে বেসরকারি হাসপাতালে মানসম্মত সেবা দেবে। এ ধরনের অবহেলাজনিত মৃত্যু দুঃখজনক।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আঁখির ঘটনা তিনি শনিবার জেনেছেন। এ বিষয়ে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে হাসপাতালে অপারেশন বন্ধ থাকবে—এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি এখনো বহাল আছে বলে মন্ত্রী জানান।
আঁখিকে অচেতন অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়। ল্যাবএইড গ্রুপের পাবলিক রিলেশন অফিসার চৌধুরী মেহের-এ-খোদা (দ্বীপ) জানান, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ ও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর ল্যাবএইড হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এই হাসপাতালে ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। সেই অনুযায়ী চিকিত্সা প্রদান অব্যাহত ছিল। রোগীর ইউরিন আউটপুট বন্ধ থাকায় ডায়ালাইসিস প্রদান করা হচ্ছিল। সব ধরনের প্রচেষ্টার পরও রোগীর কোনো উন্নতি হয়নি।
হাসপাতাল জুড়ে শোকের ছায়া :মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর খবরে হাসপাতাল জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। অন্য রোগীর দর্শনার্থীদেরও তা দেখে চোখ ছলছল করছে। আঁখির মৃত্যুর খবর শুনে শোকে আহাজারি করছিলেন তার চাচা।
তদন্ত কমিটি করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ :এদিকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে মেজর জেনারেল হারুনুর রশীদকে। আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। এদিকে চিকিত্সকদের একটি গ্রুপ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছেন। একশ্রেণির ডাক্তারদের কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অসহায়। তবে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। সবার জন্য আইন সমান। কোনো ডাক্তার রোগী মারেন না। তবে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনাটি ব্যতিক্রম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না।
ডা. সংযুক্তা সাহার গ্রেপ্তার দাবি আঁখির সহপাঠীদের :আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় ডা. সংযুক্তা সাহাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে ইডেন কলেজেন অধ্যয়নরত সহপাঠীরা। একই সঙ্গে সেন্ট্রাল হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল করে এক দিনের মধ্যে বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। আঁখির মৃত্যুর খবরে রবিবার বিকালে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে এসে এমন প্রতিক্রিয়া জানান তারা। ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত মুনিরা আঞ্জুম বলেন, ‘আজ আমার সহপাঠী আঁখি মারা গেল। সবাই তাকে দেখতে আসছে, তার খোঁজ নিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেন্ট্রাল হাসপাতালের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি, খোঁজখবরও নেয়নি। এমনকি যার আশ্বাসে আঁখি ঢাকায় এসেছিল, সেই ডা. সংযুক্তা সাহাও রোগীকে দেখতে আসেনি। আমরা মনে করি, সেন্ট্রাল হাসপাতাল বা ডা. সংযুক্তা কেউই এই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না।’
মাহবুবা রহমান আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢোকানো হয়, তখনো আমি ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না, জানতে চাই। কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানতে পেরেছি, ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনো রকম চেকআপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিত্সকদের প্রচারে মানা :চিকিত্সকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কোনো ধরনের ‘প্রচার চালানোর’ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রবিবার হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ বি সিদ্দিকের সই করা এক নোটিশে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।