ফাঁস করা প্রশ্নে হয়েছেন ২ হাজারের বেশি ডাক্তার


মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে ডাক্তার হয়েছেন দুই সহস্রাধিকের বেশি শিক্ষার্থী। প্রশ্ন ফাঁস চক্রটি ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১৫০ জনের মতো ভর্তি করিয়েছে। এদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ী, ডাক্তার ও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানরাও রয়েছেন।

মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এদের মধ্যে সাত জনই হলেন চিকিৎসক। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের মেশিনম্যান সালামের ভাইও জড়িত। সারা দেশে প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য রয়েছে ৮০ জন। এর মাস্টারমাইন্ড হলেন জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া।  সারা দেশে আগামী ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। এই পরীক্ষাকে সামনে রেখে চক্রটি তৎপরতা শুরু করে। সিআইডির একটি দলও এই সংঘবদ্ধ চক্রটিকে গ্রেফতারে অনুসন্ধানে নামে।

সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ডসহ যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে সারা দেশে অভিযান চলছে। পাবলিক পরীক্ষা সামনে রেখেই একটি চক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই চক্র নানা কায়দায় প্রশ্নফাঁস যেমন করে, তেমনি গুজব ছড়িয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করে। তিনি বলেন, দেশের মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার ইউনিট। তাদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে এ ইউনিট।

একটি সূত্র জানায়, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আগে মামলা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত ছাড়া এই মামলাটি ১০ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি দপ্তরে পড়েছিল। সিআইডির একটি সাইবার টিম আগের ও বর্তমান মামলা পর্যালোচনা করে প্রশ্নফাঁস চক্রটি ধরতে তৎপর রয়েছে। এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতারের উদ্যোগ নিয়েছে সিআইডি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন আমাদের নিজস্ব মেশিনে ছাপানো হয়। নিজেরা প্যাকেট করি এবং নিজ হাতে তা সরবরাহ করা হয়। এখন আর স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসে ছাপি না। এখন আর কোনো অবস্থাতেই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সুযোগ নেই বলে তিনি জানান।

এদিকে ১৬ বছরে ১০ বার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডি প্রধান। গতকাল রবিবার ঢাকায় সিআইডির সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।        

গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সিআইডি। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ, ডা. সোহেলী জামান, ডা. মো. আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন ওরফে শোভন, ডা. মো. জোবাইদুর রহমান ওরফে জনি, ডা. জিলুর হাসান ওরফে রনি, ডা. ইমরুল কায়েস ওরফে হিমেল, জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে মুক্তার, রওশন আলী ওরফে হিমু, আক্তারুজ্জামান তুষার, জহির উদ্দিন আহমেদ ওরফে বাপ্পী ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার। এর মধ্যে দুই জন জামায়াতের ও এক জন বিএনপির নেতা। 

২০২০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে জসীম উদ্দীন ও মোহাম্মদ সালামকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ছিলেন জসীম। তার খালাতো ভাই সালাম স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান। তারা আদালতে জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে সবশেষ গ্রেফতার ১২ জনের নাম আসে।

শিক্ষিত লোকজন এই চক্রে জড়িত। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তারা বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনেক ব্যাংক চেক ও পরীক্ষার প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে।

সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেফতার ১২ জনের মধ্যে দুজন স্বামী-স্ত্রী। তারা হলেন—ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ও ডা. সোহেলী জামান। ময়েজ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। পরে ফেইম নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়ান। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মানি লন্ডারিং উভয় মামলার স্বামী-স্ত্রী এজাহারভুক্ত আসামি। ময়েজ ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। পরে তিনি জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পান। তার স্ত্রী সোহেলীও এই চক্রের সদস্য। তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। সোহেলী জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিত্সক।

আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রাইভেট কোচিং সেন্টার চালাতেন।

জেড এম সালেহীন শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেন। ছিলেন সেখানে ছাত্রদল নেতা। পরে থ্রি-ডক্টরস নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি ২০১৫ সালে র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন।

জাবাইদুর রহমান মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। তিনি ২০০৫ সালে এই চক্রে যুক্ত হন। তিনি জসীমের সহযোগী ছিলেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক হন। বর্তমানে তিনি যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। জিলুর হাসান পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক। তিনি ২০০৫ সালে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৫ সালের মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় তিনি র‍্যাবের হাতে রংপুর থেকে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। রংপুর মেডিক্যালে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। তিনি বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে জড়িত।

ইমরুল কায়েস তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। ইমরুল বেসরকারি কমিউনিটি-বেজড মেডিক্যাল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে পাশ করেন। গ্রেফতার জহিরুল ইসলাম জসীমের বড় ভাই। তিনি নিজে একটি চক্র চালাতেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে তিনি অনেক শিক্ষার্থীকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। রওশন আলী চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রওশন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।

আক্তারুজ্জামানও জসীমের সহযোগী ছিলেন। ই-হক নামের কোচিং সেন্টার চালাতেন তিনি। ২০১৫ সালে তিনি র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। জহির উদ্দিনও জসিমের সহচর ছিলেন। তিনি ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। তিনি প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিক্যাল কোচিং সেন্টারে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতেন। আব্দুল কুদ্দুস টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি অবসরে গেছেন। তিনিও জসীমের সহযোগী ছিলেন। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার ওরফে কলিকে ভর্তির মাধ্যমে তিনি এই চক্রে জড়ান। পরে ছেলে ইমরুল কায়েসকে নিয়ে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের সিন্ডিকেট।





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/655595/%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%B8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A7%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0

Sponsors

spot_img

Latest

Short Bitcoin Funds Favored as Grayscale ETF Hype Fades

Crypto fund outflows continued last week despite signs of optimism a week prior. Amid this streak,...

Disciplinary hearing blow for Ireland U20s as two more players banned

Ireland have suffered a double blow at the Junior World Championship, starting back-rower James McNabney and replacement Rory Telfer both receiving three-match...

Liverpool and Everton charged by Football Association for Merseyside derby ‘mass confrontation’ that saw Conor Coady grab Andy Robertson’s neck after Reds star laughed...

The Football Association have charged both Liverpool and Everton for a clash between their players during the Merseyside derby. Late on in the match,...

A Rationalist Guide to Dating

The twenty-third episode (Apple Podcasts link here and Spotify link here) of Strangers on the Internet with co-host and psychologist Michelle Lange is a Presidents' Day bonus feature with Volokh...

6 Guiding Principles Behind Every Successful Company

Opinions expressed by Entrepreneur contributors are their own. A search for "formula...