যুদ্ধের অভিঘাতে বন ও বন্যপ্রাণী


প্রায় এক বছর আগে শুরু হয় ইউক্রেনে যুদ্ধ। ইউক্রেনের মাটিতে বোমা ফেলে যে সংঘাত শুরু করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, দিনকে দিন তা কঠিনতর আকার ধারণ করছে! শুরুর দিন থেকে এখন অবধি চলমান যুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় ৭ হাজার বেসামরিক মানুষ। আহত ১১ হাজারের বেশি। আনুমানিক ১০ হাজার সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজার ত্রিশেক। এছাড়া এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ৫ হাজারের মতো সেনাসদস্য। বলা বাহুল্য, এই সবকিছু ছাড়িয়ে একটি উদ্বেগজনক বিষয়ে দৃষ্টি নিবিষ্ট হয়েছে সবার। মানুষের প্রাণহানির ভয়ংকর পরিসংখ্যানের পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধে বন্যপ্রাণীর বিপর্যস্ত চিত্র চোখে পড়ার মতো। এই যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব প্রাণীর ওপর কতটা তীব্রভাবে প্রতিঘাত করছে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ইউক্রেনে ব্যাপক হারে ডলফিনের মারা যাওয়া। অন্তত ৭০০ ব্ল্যাক সি ডলফিন মারা গেছে এই যুদ্ধের কারণে। এভাবে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের প্ররিবেশ-প্রতিবেশ যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে দেশটি প্রাণিশূন্য হয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

গত মাসে মন্ট্রিলে জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের পরিবেশমন্ত্রী রুসলান স্ট্রিলেটস বলেছেন, ‘বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনের হাজার হাজার প্রাণী মারা পড়েছে চলমান যুদ্ধে। খালি চোখে একে ততটা বড় বিষয় মনে না হলেও পরিবেশের জন্য এটা কতটা মারাত্মক, তা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ড ও সমুদ্রাঞ্চল দখলের পর যুদ্ধবাজ পুতিন এসব ক্ষেত্রে কী ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়ে চলেছেন, তা কল্পনা করতেও ভয় পাই। ইউক্রেনের মাটিতে যে হারে মাইন পুঁতে রেখেছে রাশিয়ান বাহিনী, তা যে পরিবেশের জন্য কতটা প্রলয়ংকরী হয়ে উঠতে পারে, তা কারো অজানা থাকার কথা নয়। এসব মাইন বিস্ফোরণে কত প্রাণ যে নির্বিচারে মারা যাবে, তা ভাবলেই শিহরিত হতে হয়।’

সত্যি বলতে, রুসলান স্ট্রিলেটসের কথার সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই। তার কথায় আমরা জানতে পারি, ‘প্রতি সপ্তাহে রাশিয়া ৫ হাজারের মতো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইউক্রেন জুড়ে। এসব হামলায় যে কেবল মানুষ মারা যায় এমনটা নয়, বরং এর ফলে ঝরে যায় বহু প্রাণীর জীবন। এভাবে ক্রমাগত প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করার কারণে ভবিষ্যতে চরম বিপাকে পড়ে যাবে ইউক্রেনবাসী। সুস্থ জীবনযাপনের পরিপূরক পরিবেশকে এভাবে ধ্বংস করার কারণে বড় মাশুল গুনতে হবে গোটা ইউরোপকেও।’

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেন ৭৪ হাজার প্রজাতির প্রাণী ও গাছপালার আবাসস্থল, যা ইউরোপের জীববৈচিত্র্যের এক-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও ইউক্রেন ইউরোপ মহাদেশের মাত্র ৬ শতাংশ জুড়ে অবস্থিত। অর্থাৎ, ইউরোপে ইউক্রেনের বনভূমি তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। অথচ সেই ইউক্রেনের পরিবেশের ওপর এহেন অত্যাচার! স্ট্রিলেটসের উল্লেখমতে, প্রায় ৬ লাখ হেক্টর ইউক্রেনীয় বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চলমান যুদ্ধে, যা দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৩২ শতাংশ। স্ট্রিলেটসকে বলতে শোনা গেছে, ‘বহু অঞ্চল পুড়ে গেছে। এর পরিমাণ যে ঠিক কত, তা নিশ্চিত করে বলতে পারাটা মুশকিল। কারণ, দখলকৃত এলাকার কোনো অংশই বাদ যায়নি রুশ সেনাদের গোলার আঘাত থেকে।’

জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য আলোচনায় অংশ নেওয়ার পেছনে স্ট্রিলেটসের আসল উদ্দেশ্য ছিল চলমান সংঘাতের কারণে ইউক্রেনের পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিশ্বকে অবহিত ও সচেতন করা। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের জীববৈচিত্র্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয় বিশ্বের সামনে, যা ভাবিয়ে তুলছে সচেতন মহলকে।

উল্লেখ করার মতো বিষয়, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির মনিটরিং টিমের সহায়তায় ইউক্রেনের সরকার রাশিয়ার সৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতির ২ হাজার ২০০-এর বেশি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে মাটি, বায়ু ও পানিদূষণ, বিষাক্ত রাসায়নিক ও আগুন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কে বহু ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই নথিতে। স্ট্রিলেটসের ভাষ্যমতে, ‘কিছু এলাকা দখলমুক্ত করার পর আমরা আরও মামলা রেকর্ড করব। আমরা দেখাতে চাই, ইউক্রেনের পরিবেশে রাশিয়ান সেনারা যেভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা গোটা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের জন্যই কতটা অশনিসংকেত! যুদ্ধের কারণে পরিবেশগত যে দূষণের সৃষ্টি হয়েছে, আগামী দিনে বিশ্বের জন্য তা কী পরিমাণে বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, চলমান যুদ্ধ ইতিমধ্যে ইউক্রেনের ২০ শতাংশ সংরক্ষিত বনভূমিকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। এর ফলে ধ্বংসের হুমকিতে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য অঞ্চলগুলো। ঝুঁকিতে রয়েছে ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন হেক্টরের পান্না নেটওয়ার্ক, যা কিনা ইউরোপের প্রকৃতি সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক হিসেবে স্বীকৃত। ৬ লাখ হেক্টরের বেশি জলাভূমি রয়েছে বড় ধরনের হুমকির মুখে। এসব জলাভূমির জীববৈচিত্র্যের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, বহু অঞ্চলকে রামসার সাইট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে উল্লেখ করতে হয়, রাশিয়ার কামানের সামনে ধুঁকছে ইউক্রেনের এই সুবিশাল প্রাকৃতিক পরিবেশ!

রাশিয়ান সেনারা আটটি প্রকৃতি সংরক্ষণাগার দখল করে তাঁবু গেড়েছে। ১০টি জাতীয় উদ্যান কবজায় নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে যাচ্ছেতাইভাবে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ৭ হাজার ৭৪০ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত গ্রেট ও স্মল কুচুগুরি দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু এলাকা রাশিয়ান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করেছে বটে, কিন্তু বেশির ভাগ এলাকাই এখনো রাশিয়ান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

রাশিয়ান বাহিনীর আট মাস দখলদারিত্বের পর গত নভেম্বরে মুক্ত করা হয় খেরসন অঞ্চলের কামিয়ানস্কা সিচ জাতীয় উদ্যান। ৯০টিরও বেশি প্রজাতির বিরল প্রাণীর আবাসস্থল এই তৃণভূমিকে বলা হয় ‘বাস্তুতন্ত্রের আঁতুরঘর’। কিন্তু রাশিয়ানরা উদ্যানটি ছেড়ে যাওয়ার আগে এখানকার ভূমি এমনভাবে ধ্বংস করে গেছে যে, বলা যায়, এই এলাকাকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে ঘাতক রুশ সেনারা। স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, বিরল উদ্ভিদ প্রজাতির এই আবাসস্থলের ৬৩৫ হেক্টর এলাকা আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে।

যা হোক, চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের পরিবেশগত যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এক কথায় ‘অপূরণীয়’। পরিবেশে যে মাত্রায় দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। এখন পর্যন্ত ৩৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরোর পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ইউক্রেন সরকারের দাবি, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব ক্ষতি করা হয়েছে, তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাশিয়াকে। ইউক্রেনের পরিবেশ মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে দাবি করে বলেছে, ‘আমরা সব মামলা রেকর্ড করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি তৈরি করছি। আমরা নিশ্চিত যে, সবকিছুই সম্ভব। অনেক দেশ আমাদের সমর্থন করবে বলেই আমরা আশা করি।’

বাস্তবিক অর্থে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রকৃতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনো মূল্যেই পূরণ হওয়ার নয়। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে—সন্দেহ নেই। সেই সংকট পুনরুদ্ধারে নগদ অর্থও ততটা কাজে আসবে না। কেননা, পরিবেশের সুস্থতা ফিরে আসতে লেগে যাবে বছরের পর বছর। ইউক্রেনের পরিবেশমন্ত্রীও বলছেন একই কথা—‘একটি গাছ কয়েক দশক ধরে বেড়ে ওঠে। কিন্তু একটি গাছ পুড়িয়ে ফেলা যায় এক নিমিষেই! সুতরাং, যেটা ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গড়ে উঠবে, তাকে এক নিমেষেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার মূল্য হবে বেশ চড়া, যাকে অর্থের বিচারে পরিমাপ করা যায় না কোনোভাবেই— এটাই প্রকৃতির নিয়ম।’

সত্যি বলতে, ইউক্রেনের পরিবেশমন্ত্রীর কথাকে অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই। যুদ্ধে হতাহতের ক্ষত তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলা গেলেও প্রাকৃতিক পরিবেশের যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তার ক্ষত শুকাতে লেগে যায় লম্বা সময়।

লেখক: পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক

ইকোলজিস্ট থেকে অনুবাদ: সুমৃত খান সুজন





Source link: https://www.ittefaq.com.bd/628081/%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%98%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A7%80

Sponsors

spot_img

Latest

House Republicans To Probe White House Pressure on Social Media Companies

House Republicans to probe Biden administration pressure on Twitter. As one of their first orders of business in the new Congress, House Republicans...

Bitcoin Struggles at $27,000 Despite Bullish Grayscale News

Bitcoin’s price has flirted with a major breakthrough but has encountered stubborn resistance. Regulatory approval for...

Score and latest updates from 3pm kick-offs

BOURNEMOUTH XI TO FACE ARSENAL: Neto; Smith, Mepham, Stephens, Senesi, Zemura; Ouattara, Billing, Rothwell, Semenyo; SolankeSubs: Travers, Randolph, Fredericks, Cook, Christie, Stacey, Moore,...

Blazers’ Chauncey Billups praises Sixers stars James Harden, Tyrese Maxey

PHILADELPHIA–The Philadelphia 76ers boast one of the more dynamic backcourts in the league in the form of James Harden and Tyrese Maxey. The...

Third-party Reddit app Apollo will shut down on June 30th

Reddit's controversial decision to charge for API access has led the creator of Apollo to shut down the third-party client. "Apollo will close...