ইন্টারনেটের আবির্ভাবে মানুষের জীবন ক্রমেই সহজ থেকে সহজতর হইয়া উঠিয়াছে। হাতের মুঠিতে থাকা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পাওয়া যাইতেছে তামাম দুনিয়ার সকল খবর, সকল তথ্য। ফলে আমাদের জীবনের নৈমিত্তিক সকল জটিল কার্যভারেরও যেন সহজ ও সরলীকরণ হইয়া গিয়াছে। তবে যে কোনো কিছুর অতি সরলীকরণও আবার অনুচিত। ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বিভিন্ন সুবিধা যেমন সহজলভ্য হইয়া উঠিয়াছে, একই ভাবে মানবস্বাস্থ্যের মতো জটিল বিষয়েরও অযাচিত সরলীকরণ করিয়া ফেলিয়াছে মানুষ। তরুণ প্রজন্মের সকলের হাতে স্মার্টফোন থাকায় তাহাদের মধ্যে শারীরিক চিকিৎসার জন্য ইন্টারনেট-নির্ভরতার লক্ষণ তুলনামূলকভাবে অধিক পরিলক্ষিত হয়। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, কোন তথ্যের জন্য ইন্টারনেট-নির্ভর হইতে হইবে আর কোন তথ্যের জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত লইতে হইবে—ইহার মধ্যকার সীমারেখা যেন দিনদিন ক্ষীণ হইয়া যাইতেছে।
মানুষের শরীর অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং জটিল একটি বিষয়। ইহার জটিলতা এতটাই প্রসার ঘটিয়াছে যে, যেই ডাক্তাররা আমাদের রোগ-শোক নিরীক্ষণ করিয়া ঔষধ দিয়া থাকেন, সেই একেক জন ডাক্তার তাহাদের জীবনের পাঁচটি বছর উৎসর্গ করিয়া দেন শুধু সাধারণ মানুষের রোগ পরীক্ষা করার একাডেমিক যোগ্যতা অর্জন করিতে। আবার মানবশরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা নির্দিষ্ট রোগবিষয়ক বিশেষ জ্ঞান লাভ করিতে তাহাদের পড়াশোনা করিতে হয় আরও কয়েক বছর। অধিকাংশ চিকিৎসকই চল্লিশ-পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে গিয়া তবেই বিশেষজ্ঞ হইয়া উঠে। বলাই বাহুল্য, ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ডাক্তারি পেশা বাছিয়া লয়। সুতরাং রোগ নির্ণয় উহার চিকিৎসাসহ প্রেসক্রিপশনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর; কিন্তু ‘ইন্টারনেটে সকল সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়’ ভাবিয়া যাহারা শারীরিক সমস্যা বা কোনো অসুখের লক্ষণ দেখিয়া ইন্টারনেটে সেই লক্ষণ লিখিয়া সার্চ দেয় এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করিতেছে, তাহারা আসলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারিতেছে। বিভিন্ন অনলাইন ফোরাম হইতে কোনো রোগের সম্ভাব্য ঔষধ কী হইতে পারে—তাহার উপর ভিত্তি করিয়া যাহারা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসা শুরু করেন—তাহাদের বলা হয় ‘সাইবারকন্ড্রিয়া’। বহুল আলোচিত ‘আইইইই এক্সপ্লোর ডিজিটাল লাইব্রেরি’ প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠিয়া আসিয়াছে যে, শুধু ঢাকা বিভাগেই ১৮ হইতে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে ৫৮ শতাংশই এই প্রবণতায় আসক্ত। ইন্টারনেটে নানা ধরনের তথ্যের যে অবাধ বিস্তার, সকলটুকুই যে সঠিক, তাহা চিন্তা করিবারও কোনো অবকাশ নাই।
হাতে একখানা মোবাইল ফোন থাকিলে আর ইন্টারনেটের জোগান থাকিলে যে কেহ চাহিলেই যেন বিশেষজ্ঞ সাজিয়া নিজের অল্পবিদ্যা জাহির করিতে পারেন। আবার এই সকল তথ্যের শুদ্ধতা যাচাই করিবারও কোনো সহজ প্রক্রিয়া নাই। অসংখ্য রোগের উপসর্গ একই ধরনের হইতে পারে। উপসর্গ সার্চ করিয়া যেই রোগের নাম পাওয়া গেল, সেই রোগই যে শরীরে বাসা বাঁধিয়াছে, তাহার কোনো নিশ্চয়তা নাই। হয়তো বুকে ব্যথার উপসর্গে কেহ ইন্টারনেটে সার্চ করিয়া জানিতে পারিলেন যে হৃদরোগের কারণে বুকে ব্যথা হয়। এই তথ্য দেখিয়া বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত হইয়া যাওয়াই স্বাভাবিক। অথচ ডাক্তারের নিকট গেলে জানা যাইত যে, উল্লিখিত বুকের ব্যথা হয়তো মামুলি কোনো শারীরিক সমস্যা হইতে হইতেছে। আবার উলটাটাও হইতে পারে। ইন্টারনেটের তথ্য দেখিয়া শরীরের উপসর্গ উপেক্ষা করিয়া সময়মতো ডাক্তার না দেখাইলে শরীরে বাসা বাঁধিতে পারে মরণব্যাধি। আবার অনলাইনের তথ্যভিত্তিক চিকিৎসা চালাইতে যাইয়া ভুলভাল ঔষধ খাইয়া শরীরের জটিলতা কমানো বই বাড়াইবার নজিরও কম না। ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়া ও খরচ দুইটির ফর্দই দীর্ঘ হইয়া যায়। আধুনিক জীবন সহজ; কিন্তু সকল কিছুতে সহজ পন্থা খুঁজিতে গেলে তাহা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হিতে-বিপরীত হইতে পারে। সুতরাং এই ধরনের মানসিকতা পরিহার আবশ্যক। শারীরিক উপসর্গ দেখা দিলে তাহা অবহেলা না করিয়া দ্রুততম সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক।